Saturday, February 22, 2014

শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রলীগের সন্ত্রাস-রাহাজানি

 নন্দীগ্রামে আওয়ামী লীগের দু-গ্রুপের সংঘর্ষের সময়  কোদাল দিয়ে পুলিশের ওপর আক্রমণ













॥ ফারুক আহমাদ ॥
মহাআতঙ্ক আর সন্ত্রাসের গডফাদারের নাম এখন ছাত্রলীগ। তাদের কীর্তিকলাপের কথা শুনলে ছাত্রছাত্রী আর দেশের সাধারণ মানুষের রাতের আরামের ঘুম হারাম হয়ে যায়। শিক্ষা, শান্তি ও প্রগতির স্লোগানধারী সংগঠনটির হাতে এখন সহপাঠী আর দেশের সাধারণ মানুষের রক্তের দাগ। আওয়ামী সরকারের গত চার বছরে এমন কোনো অন্যায়-অত্যাচার এবং হীন কোনো কাজ নেই যা তারা করেনি। এদের অসৎ কার্যক্রমকে বৈধতা দিতে আওয়ামী নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দলটির সাংগঠনিক দলনেতার পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে আরো প্রবল শক্তির জায়গা করে দিয়েছেন। মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে হার মানিয়েছে ছাত্রলীগের জুলুম, নির্যাতন। ছাত্রলীগের সংঘর্ষের কারণে ৬৮ বার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে। হল ছাড়া হয়েছে প্রায় ২০-২৫ হাজার শিক্ষার্থী।

চারবছরে ছাত্রলীগের নানা সংঘর্ষ
গত চার বছরে বিভিন্ন শিা প্রতিষ্ঠানে ১৮৭টি সংঘর্ষ করেছে ছাত্রলীগ। তার মধ্যে বিভিন্ন থানা ও জেলা শাখায় হয় ৪৮টি। এতে প্রতিপক্ষের ছাত্র আহত হয়েছেন ৩ হাজার ১৪৫ জন। পুলিশ, সাংবাদিক,  কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপ, ছাত্রীর অভিভাবক বাদী হয়ে ও নিজেদের এক গ্রুপ অপর গ্রুপের বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা দায়ের করেছে ৫৪২ জনের বিরুদ্ধে, যার মধ্যে ৪৯৫ জনকে বিভিন্ন অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া অন্য সংগঠনের নেতাকর্মী ও বিভিন্ন এলাকাবাসীর ওপর হামলা করে ৫৬টি।
২০০৯ সালের ১৩ মার্চ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের সাধারণ সম্পাদক শরিফুজ্জামান নোমানীকে হত্যার মধ্যে দিয়ে ছাত্রলীগ খুনের কার্যক্রম শুরু করে। এই ধারাবাহিকতা এতটাই লম্বা হয়েছে যে, তারা চার বছরে ২৩ জন ছাত্রকে হত্যা করেছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের ১২ তারিখে তেজগাঁও পলিটেকনিক্যালে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে আহত হয় ২০ জন। ১১ তারিখে রাবিতে ছাত্রদলের উপর হামলায় আহত হয় ৩০ জন। আগস্ট মাসে ইবিতে চাকরি বাণিজ্য নিয়ে ছাত্রলীগ তাণ্ডব চালায়। এতে আাহত হয় ৪০ জন। ৬ তারিখে জমি দখলকে কেন্দ্র করে ৬ জনকে আহত করে। জুলাই মাসে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় মাছ ধরাকে  কেন্দ্র করে ২৭ জনকে আহত করে। ২৪ তারিখে খুলনায় ৮ কোটি টাকায় টেন্ডার জমাকে কেন্দ্র করে পুলিশ সাংবাদিকসহ ৫ জনকে আহত করে। ২৫ তারিখে কুড়িগ্রামে ফুলবাড়ীতে পুলিশের ২ এসআইকে আহত করে। ২৪ তারিখে যশোরের আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এড.আব্দুল গফুরকে কুপিয়ে আহত করে। ১৬ তারিখে রাবিতে দু’গ্রুপের সংঘর্ষে নিজ দলের কর্মী সোহেলকে হত্যা করে।  
৮ তারিখে সিলেটের ঐতিহাসিক এমসি কলেজে আগুন লাগিয়ে ছাত্রাবাস পুড়িয়ে দেয়। ২ তারিখে বরিশাল মেডিক্যালে ছাত্রদলের উপর হামলা চালিয়ে ১০ জনকে আহত করে। ১ তারিখে সিলেটের দক্ষিণ ডিগ্রি কলেজে ৫ জন শিবির কর্মীসহ ৩৫ জনকে আহত করে। জুন মাসের ২৮ তারিখে নেত্রকোনায় রামদা মিছিল বের করে। ২২ তারিখে ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের কাছ থেকে ৩ হাজার অস্ত্র উদ্ধার করে পুলিশ। একই দিন মাদারীপুরে পুলিশের উপর হামলা করে ৬ পুলিশকে আহত করে। ৯ তারিখে শাবিপ্রবিতে ফাহিম মাহফুজ নামের কর্মীকে হত্যা করে। ৪ তারিখে যশোরের এমএম কলেজে মোশাররফ নামের ছাত্রকে আহত করে। মে মাসের ২২ তারিখে ঢাবিতে মারপিট করে টাকা ও ল্যাপটপ লুট করে নিয়ে যায়। ১৬ তারিখে রাজশাহীতে সানি হত্যা মামলায় ছাত্রলীগের ২ জনের মৃত্যুদণ্ড ও ৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। ১৪ তারিখে সিলেটের সালিয়াগ্রামের জমি দখল করতে গিয়ে ৫০ জন গ্রামবাসীকে আহত করে।  পুলিশ ২০ জন নেতাকর্মীকে আটক করে। 
এপ্রিল মাসের ১৩ তারিখে জবিতে দু’গ্রুপের সংঘর্ষে ৭ জনকে আহত করে ও ১৭ জনকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হয়। ২৮ তারিখে জাবিতে সাংস্কৃতিক কর্মীদের উপর হামলা করে ৭ জনকে গুরুতর আহত করে। ২৯ তারিখে ঢাকা কলেজে দু’গ্রুপের সংঘর্ষে ২৫ জনকে আহত করে। ২৫ তারিখে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ডাক্তারদের উপর হামলা করে। ১১ তারিখে চাঁদপুরের বিল্লাল নামের নিজ দলীয় কর্মীকে হত্যা করে। ৮ তারিখে বাংলাদেশ ফটোজার্নালিস্ট এসোসিয়েশনে হামলা চালায়। ২৯ মার্চ ঝালকাঠিতে ২০ লাখ টাকার টেন্ডার নিয়ে দু’গ্রুপের মাঝে সংঘর্ষে ১০ জন আহত হয়। ২১ তারিখে ছাত্রলীগ পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীদের সাথে সংঘর্ষ করে ১ জন নিহত হয়। ২৮ তারিখে ফাও মদ খাওয়াকে কেন্দ্র করে তিতুমীর কলেজে হামলা চালায়। ১৩ তারিখে বিএনপির মহাসমাবেশে আগত লোকদের উপর জায়গায় জায়গায় হামলা চালায়। 
ফেব্রুয়ারি মাসের ২৭ তারিখে রাজশাহীর পটিয়ায় ছাত্রী অপহরণ করে। এতে গ্রামবাসী ৩ জনকে ধরে পুলিশে দেয়। ১৪ তারিখে পিস্তলসহ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় উপ-বিজ্ঞান সম্পাদক মোস্তাকিম মোরশেদ গ্রেফতার হন। ১১ তারিখে সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজে হামলা চালিয়ে ৩৩টি রুম ভাঙচুর করে ৭ জনকে আহত করে। ১৩ তারিখে দিনাজপুরের টেক্সটাইল কলেজ বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৪ তারিখে পটুয়াখালী জেলা পরিষদের ২৫০ কোটি টাকার টেন্ডার ছিনিয়ে নিয়ে যায়। পহেলা জানুয়ারিতে রাবিতে পুলিশ ও শিবির কর্মীকে কুপিয়ে যখম করে। ৪ তারিখে খুলনার আজম খান কলেজে ছাত্রদলের সাথে সংঘর্ষ বাঁধিয়ে ১১০ জনকে আহত করে। ২৪ তারিখে জাবিতে ছাত্রকল্যাণ সমিতির চাঁদাবাজিতে দু’গ্রুপের সংঘর্ষে ১৫ জনকে আহত করে। ২৫ তারিখে বরিশালে বিএনপির অনুষ্ঠানে হামলা চালিয়ে ১০ জনকে আহত করে। ১৭ তারিখে মৌলভীবাজারে ওরসের চাঁদাবাজি করতে গিয়ে ৩০ জনকে আহত করে। ৯ তারিখে জাবিতে ৪ জন ছাত্রকে ৩ ও ৪ তলা থেকে নিচে ফেলে দিয়ে আহত করে। শাবিপ্রবিতে ৯ তারিখে জুবায়েরকে হত্যা ১২ তারিখে হামলা চালিয়ে ২০ জনকে আহত করে। ৪ তারিখে সাংবাদিক ও পুলিশসহ ২৫ জনকে আহত করে। ৭ তারিখে নাটোরে চাঁদাবাজি করতে গিয়ে জেলা সাধারণ সম্পাদক আতিকুজ্জামান ও সরোয়ার জামান প্রিন্স গ্রেফতার হয়।
৫ তারিখে রংপুরের রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের উপর হামলা চালিয়ে ২৫ জনকে আহত করে। ৩ তারিখে শাবিপ্রবি, কুয়েট, ঢাবি ও বুয়েটে হামলা চালিয়ে ৭০ জনকে আহত করে। ২৮ তারিখে ঢাকা পলিটেকনিক্যালে দু’গ্রুপের সংঘর্ষে ১০জন আহত হয়। ২৫ তারিখে মাগুরায় খাবার বিতরণকে কেন্দ্র করে নিজ দলীয় কর্মী আল আমীনকে হত্যা করে। ৩ তারিখে জবিতে ছাত্রজোটের ১৫ কর্মীকে আহত করে। ২ তারিখে কুয়েটে ৬ শিক্ষকসহ ২০জনকে আহত করে। ২ তারিখে রাবি, কুয়েট, ঢাবিতে হামলা চালিয়ে ৬০ জনকে আহত করে। ১ তারিখে রাবিতে পুলিশ ও শিবির কর্মীকে কুপিয়ে যখম করে। ২০১১ সালের ২৫ অক্টোবর ইবিতে শিবিরের উপর হামলা চালিয়ে ২০ জন নেতাকর্মীকে আহত করে। ২৬ ডিসেম্বরে ছিনতাইয়ের অভিযোগে ৬ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়। ২৪ তারিখে খুলনার আজম খান কলেজে হামলা চালিয়ে ১৫ জনকে আহত করে। ১৯ তারিখে সুনামগঞ্জে জেলা প্রশাসক নিয়োগকে কেন্দ্র করে ১০ জনকে আহত করে। ২৫ তারিখে চট্টগ্রামে আদালত চত্বরে কর্নেল অলির উপর হামলা চালিয়ে ৩০ জনকে আহত করে। ১২ তারিখে ছাত্রদল ও পুলিশের উপর হামলা চালিয়ে ১২ জনকে আহত করে। নভেম্বরের ১৫ তারিখে বি-বাড়িয়ায় হামলা চালিয়ে ৮ পুলিশকে আহত করে। ১৪ তারিখে সিলেটের মদনমোহন কলেজে অবৈধভাবে পরীক্ষা দিতে গিয়ে ভাঙচুর চালায়। একই দিন বরিশালের কেশবপুরে ব্যবসায়ীদের উপর হামলা চালিয়ে ১৫ জনকে আহত করে। ১০ তারিখে নাজিরপুর থানায় হামলা চালায়। ২৩ অক্টোবর ছাত্রদল কর্মী আবিদকে হত্যা করে। 
১১ তারিখে ফেনীর পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১২ গ্রুপের ২২ কোটি টাকার টেন্ডার ছিনিয়ে নেয়। ৫ তারিখে শীতলক্ষ্যায় হামলা চালিয়ে ৬ জনকে আহত করে। ২ তারিখে এমবিবিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রতারণায় জড়িত থাকার অভিযোগ ৫২ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয়। ২৪ সেপ্টেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ডের রাস্তা মেরামতের ৩ কোটি ৫৬ লাখ টাকার টেন্ডার ভাগবাটোয়ারা করে নিয়ে যায়। ২২ তারিখে ঢাবিতে দু’গ্রুপের সংঘর্ষে ৯ জন আহত হয়। ২১ তারিখে তেজগাঁও পলিটেকনিক্যালে ফাও খেতে গিয়ে সংঘর্ষ বাধিয়ে রাইসুল নামের কর্মীকে নিজেরাই হত্যা করে। ১২ তারিখে বগুড়ায় ছাত্রদলের উপর হামলা চালায়। আগস্ট মাসের ২৯ তারিখে গাজিপুর পৌরসভার ৪৩টি প্রকল্পের ১৮ কোটি টাকার টেন্ডার ছিনিয়ে নিয়ে যায়। ২৫ তারিখে বরিশাল জেলার সেতু বিক্রি করে দেয়। ১৮ তারিখে কিশোরগঞ্জ জেলার টেন্ডার ছিনতাই করে। ১৬ তারিখে ময়মনসিংহের ত্রিশালে কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’গ্রুপের সংঘর্ষে ১১ জন আহত হয়। ১৫ তারিখে সিলেটের মেট্রো ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে হামলা ও ভাঙচুর করে ৬ জনকে আহত করে। ৯ তারিখে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০ শিক্ষককে আহত করে।  
ছাত্রলীগের হাতে ২৩ খুন : বর্তমান সরকারের প্রায় চার বছরে দেশের বিভিন্ন শিাপ্রতিষ্ঠানের ২৩ জন মেধাবী ছাত্রকে খুন করেছে ছাত্রলীগ, তার মধ্যে ৯ জনই ছাত্রশিবির নেতা-কর্মী। ২০০৯ সালের ১৩ মার্চ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের সাধারণ সম্পাদক শরিফুজ্জামান নোমানীকে হত্যার মধ্যে দিয়ে ছাত্রলীগ খুনের কার্যক্রম শুরু করে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খুনের ঘটেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ৮ ফেব্র“য়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ও শিবিরের মধ্যে রক্তয়ী সংঘর্ষে দুই শিবিরকর্মী প্রাণিবিদ্যা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মুজাহিদ এবং ইংরেজি শেষ বর্ষের ছাত্র মাসুদকে খুন করে ছাত্রলীগ।
এছাড়া ২০১০ সালের ১১ ফেব্র“য়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের মহিউদ্দিন, ২০১০ সালের ২৮ মার্চ মার্কেটিং বিভাগের হারুন অর রশিদ কায়সার, ১৫ এপ্রিল হিসাববিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের আসাদুজ্জামানকে খুন করে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পর সবচেয়ে বেশি ছাত্রকে খুন করা হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্রশিবিরের ওপর ছাত্রলীগের হামলা এবং ছাত্রলীগের দু’গ্র“পের সংঘর্ষে বর্তমান সরকারের মেয়াদে নিহত হয়েছেন ৩ জন ছাত্র।

২০০৯ সালের ১৩ মার্চ ছাত্রলীগের পৈশাচিকতায় নিহত হন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের সাধারণ সম্পাদক শরিফুজ্জামান নোমানী। ২০১০ সালের ৮ ফেব্র“য়ারি নিহত হন ছাত্রলীগ কর্মী (ছাত্রলীগের দাবি) ফারুক হোসেন। ১৫ আগস্ট নাসিম এবং ১৬ জুলাই অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুন হন ছাত্রলীগ কর্মী সোহেল। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১০ সালের ২ ফেব্র“য়ারি ছাত্রলীগ-পুলিশের সংঘর্ষে নির্মমভাবে খুন হন নিরীহ ও মেধাবী ছাত্র আবুবকর। ৮ জানুয়ারি নিহত হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ কর্মী ও ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের আহমেদ। ২০০৯ সালের ৩১ মার্চ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ ওরফে রাজীব, ২০১০ সালের ১২ জুলাই সিলেট এমসি কলেজে ছাত্রলীগ কর্মী পলাশ, ২০১১ সালের ২০ অক্টোবর চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে ছাত্রদল নেতা চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আবিদুর রহমান। ২০১০ সালের ৭ জানুয়ারি রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ছাত্রমৈত্রীর সহ-সভাপতি রেজানুল ইসলাম চৌধুরী, ২১ জানুয়ারি পাবনা টেক্সটাইল কলেজের ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী মোস্তফা কামাল শান্ত, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১১ নিহত হন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাইসুল ইসলাম রাহিদ। সর্বশেষ ২০১২ সালের ১২ মার্চে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্মী সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আবদুল আজিজ খান সজীবকে খুন করে ছাত্রলীগ।
৬৮ শিা প্রতিষ্ঠান বন্ধ : ছাত্রলীগ-ছাত্রলীগ এবং ছাত্রলীগ-প্রতিপরে মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় অন্তত ৬৮টি উচ্চশিা প্রতিষ্ঠান অনির্ধারিতভাবে বন্ধ হয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন শিা প্রতিষ্ঠানে সংগঠিত হয় ১৮৭টি সংঘর্ষ। তার মধ্যে বিভিন্ন থানা-জেলা শাখায় হয় ৪৮টি। আহত হয়েছে ৩ হাজার ১৪৫ জন। পুলিশ, সাংবাদিক, কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপ, ছাত্রীর অভিভাবক বাদি হয়ে ও নিজেরা এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের নামে পাল্টা মামলা দায়ের করেছে ৫৪২ জনের বিরুদ্ধে, যার মধ্যে ৪৯৫ জনকে বিভিন্ন অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া অন্য সংগঠনের নেতাকর্মী ও বিভিন্ন এলাকাবাসীর ওপর হামলা হয় ৫৬টি। বড় আকারের সংঘর্ষ হয়েছে এমন শিা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ,জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা প্রকৌশল, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল (বুয়েট), শেরে-ই-বাংলা কৃষি, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি,রাজশাহী প্রকৌশল এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। কলেজের মধ্যে রক্তয়ী সংঘর্ষ হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ,ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, বদরুন্নেসা মহিলা কলেজ, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ, তিতুমীর কলেজ, সরকারি বাঙলা কলেজ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম সিটি কলেজ, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি কলেজ, চট্টগ্রাম পলিটেকনিক কলেজ, রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ, রংপুর মেডিক্যাল কলেজ, খুলনা বিএল কলেজ, মেহেরপুর কলেজ, সিলেট এমএম কলেজ, সিলেট এমসি কলেজ, বরিশাল বিএম কলেজ, শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ, বরিশাল পলিটেকনিক কলেজ, সিলেট মেডিক্যাল কলেজ, সিলেট সরকারি কলেজ ও সিলেট পলিটেকনিক কলেজ।
শিক লাঞ্চিত ও নির্যাতিত: আওয়ামী সরকারের পৌনে চার বছরে বিভিন্ন শিা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের হাতে অন্তত ৮০ জন শিক লাঞ্ছিত ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ছাত্রলীগের হাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ ও আবাসিক হলে অন্তত ২০ শিক লাঞ্ছিত ও হামলার শিকার হয়েছে। লাঞ্ছনার শিকার হয়ে বেশ কয়েকটি হলের প্রভোস্ট পদত্যাগ করতে পর্যন্ত বাধ্য হন। তাছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিকদেরও লাঞ্ছিত করে চলেছে। ২০১১ সালের ২০ আগস্ট বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ শিককে পিটিয়ে আহত করে। ২৩ নভেম্বর ইউনিফর্ম ছাড়া এক শিার্থীকে পরীার হলে প্রবেশ করতে না দেয়ায় নোয়াখালী সরকারি কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক জুলফিকার হায়দারকে ছাত্রলীগ নেতা সোহরাব ইকবাল লাঞ্ছিত করে। গত বছরের ২২ জানুয়ারি মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এফ রহমান হলের ছাত্রলীগ নেতাদের আবাসিক মেয়াদ শেষ হওয়াকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের হাতে তিন শিক লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা ঘটে। শিকরা হলেন প্রাধ্য আজিজুর রহমান, হলের আবাসিক শিক মাহবুব কায়সার ও অধ্যাপক আশফাক হোসেন। ২২ মার্চ রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার মাছপাড়া ডিগ্রি কলেজের উপাধ্যসহ তিনজন শিককে লাঞ্ছিত করে ছাত্রলীগের কর্মীরা। এর আগে ২০১০ সালের ২৫ ডিসেম্বর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ ক্যাডাররা লাঞ্ছিত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ শিককে। একই বছরের ১০ মে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে কাসে হামলা চালিয়ে এক শিকিাকে লাঞ্ছিত ও ১০ ছাত্রীকে আহত করে। ১১ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের দুই শিককে লাঞ্ছিত করে।
শতাধিক সাংবাদিক লাঞ্ছিত : গত ৪ বছরে ঢাবি, জবি, জাবি, চবি, রাবি, কুবি, ইডেন কলেজ, ঢাকা কলেজসহ বিভিন্ন জেলা ও শহরে ছাত্রলীগের হাতে দেড় শতাধিকের বেশি সাংবাদিক লাঞ্ছিত হয়েছেন। নির্যাতিত হয়েছেন প্রায় আরো শতাধিক।
ছাত্রী উত্ত্যক্ত ও ধর্ষণ : গত ৪ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিাপ্রতিষ্ঠান ও স্থানে শতাধিক নারী ও ছাত্রী উত্ত্যক্ত, লাঞ্ছনা ও ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১০ সালে বৈশাখী অনুষ্ঠান ও থার্টিফাস্ট নাইটের অনুষ্ঠানে অন্তত ২০ নারী ও ছাত্রী লাঞ্ছিত হন ছাত্রলীগের হাতে। জাহাঙ্গীরনগরে ঘটেছে ছাত্রী উত্ত্যক্তের ঘটনা। বরিশাল বিএম কলেজের এক ছাত্রীর নগ্ন দৃশ্য এক ছাত্রলীগ কর্মী মোবাইলে ধারণ করায় ওই ছাত্রী আত্মহত্যা করে। ২০১০ সালের ২৬ এপ্রিল দিনে-দুপুরে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে এক ছাত্রীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে ছাত্রলীগ কর্মীরা। ২০১০ সালের ২ অক্টোবর বরিশালের মুলাদীতে ছাত্রলীগ কর্মীরা ধর্ষণ করেছে দুই বোনকে।
দেহব্যবসা : দেহব্যবসার সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতা-নেত্রীদের জড়িত থাকার অভিযোগও ছিল গত ৪ বছরের আলোচিত ঘটনা। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতা এবং কয়েকটি শাখা কমিটির নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ ওঠে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি ছাত্রী হল, ইডেন সরকারি মহিলা কলেজ, বদরুন্নেসা মহিলা কলেজ শাখা ছাত্রলীগ নেত্রীদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ ওঠে। এছাড়া সংগঠনটির কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাও ওই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। অভিযোগ রয়েছে, নিজ সংগঠন এবং এর বাইরে সুন্দরী মেয়েদের জোর করে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের বাসায় মনোরঞ্জনের জন্য পাঠানো হতো। আবার অনেকে দলে পদ পেতে নিজ ইচ্ছায় যেত। এছাড়া সরকারের মন্ত্রী, এমপি, প্রভাবশালী নেতা, ব্যবসায়ীদের মনোরঞ্জনের জন্য দেহব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে ছাত্রলীগ।
টেন্ডার-চাঁদাবাজি: দেশের প্রায় সব বড় শিা প্রতিষ্ঠানে ও শহরে চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজিতে জড়িয়ে পড়ে ছাত্রলীগ। চাঁদা না দেয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠান ও দোকান বন্ধ করে দেয়া হয়। রাজধানীর শিাভবন, গণপূর্ত ভবন, খাদ্য ভবন থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার টেন্ডার বাগিয়ে নেয় ছাত্রলীগ। নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি নিয়ে বেশ কয়েকবার সংঘর্ষও হয়েছে। চাঁদা দিতে দেরি বা অপারগতা প্রকাশ করায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিা প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন জেলা শহরের বড় বাজেটের উন্নয়ন কাজ বন্ধ রাখা হয়। এছাড়া বিভিন্ন মার্কেট ও উৎসব থেকে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি করে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্যে ৭০-৮০টি কলেজের উন্নয়ন অনিশ্চিত হয়ে যায়। ৬৫৫ কোটি ১২ লাখ টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাগিয়ে নেয় ছাত্রলীগ। এসব অপকর্মে ছাত্রলীগের সাবেক-বর্তমান কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে পাতি নেতারাও জড়িয়ে পড়েন।
ভর্তি ও নিয়োগ বাণিজ্য : গত ৪ বছরে বিভিন্ন মেডিক্যাল, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ভর্তি এবং নিয়োগ বাণিজ্য হয় রমরমা। বিপুল অঙ্কের টাকার বিনিময়ে মেডিক্যালে ভর্তি এবং চাকরি দেয়ার নামে শত কোটি টাকা কামিয়ে নিয়েছে ছাত্রলীগ। একেকজন প্রার্থীর কাছ থেকে এজন্য ১ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়। অনার্স ভর্তিতে বড় বড় অনার্স কলেজে প্রশাসনকে জিম্মী করে ছাত্রলীগ কোটার নামে হাজার হাজার ছাত্র ভর্তি করা হয়। ৩০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়। রাজধানীতে ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ, তিতুমীর কলেজ, মিরপুর বাঙলা কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, বদরুন্নেসা কলেজ, সোহরাওয়ার্দী কলেজ, খুলনা কমার্স কলেজ, বিএল কলেজ, রাজশাহী সিটি কলেজ, মহিলা নিউ গভ.ডিগ্রি কলেজ, রাজশাহী কলেজ, বরিশালের বিএম কলেজ, সিটি কলেজ, চট্টগ্রামের সিটি কলেজ ও মুহসীন কলেজে ভর্তি বাণিজ্য ছিল আলোচিত। ভর্তি ও নিয়োগ বাণিজ্যে জড়িত ছিলেন ছাত্রলীগের পাতি নেতা থেকে শুরু করে মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা পর্যন্ত।
ছাত্রসংগঠনগুলোর বক্তব্য : ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি এইচএম বদিউজ্জামান সোহাগের সাথে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি মো.দেলাওয়ার হোসেন বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হত্যা, সংঘর্ষ, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, অস্ত্র বিক্রিসহ নানা ধরনের অপকর্ম করে যাচ্ছে ছাত্রলীগ। তাদের অন্যায়ের কোনো বিচার করা হচ্ছে না। এতে করে ছাত্রলীগ আরো বেশি করে অসৎ কাজ করে যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রশিবির,ছাত্রদল ও অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীদের ঢুকতে বাধা দিচ্ছে। এ সরকারের আমলে তারা ছাত্রশিবিরের ৯ জন নেতাকর্মীকে নিমর্মভাবে হত্যা করেছে। এসবের একটিরও বিচার করেনি বর্তমান ফ্যাসিবাদী এই আওয়ামী সরকার।

No comments:

Post a Comment