Wednesday, February 19, 2014

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ বছর ধরে বেপরোয়া ছাত্রলীগ

জাকির হোসেন তমাল

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) গত পাঁচ বছরে বিশ্ববিদ্যালয় ও পুলিশ প্রশাসনের মদদে অস্ত্রবাজিসহ বিভিন্ন বিষয়ে বেপরোয়া ছিল ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের লাগামহীনতার কারণে গত পাঁচ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে চার ছাত্র নিহত হয়েছে। নিজ দল ও প্রতিপক্ষের সাথে অন্তত শতাধিক সংঘর্ষে আহত হয়েছে পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী। এমনকি তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ছাত্রী ও শিক্ষকরা। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হাতে একাধিকবার পুলিশ পেটানোর ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়াও অস্ত্রবাজি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, টেন্ডারব্যবসা, শিক্ষার্থীদের মারধরে এক মৃত্যুপুরিতে পরিণত হয়েছে মতিহারের এই সবুজ চত্বর। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাবিতে এম আব্দুস সোবহান উপাচার্য হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রশাসনের অনৈতিক সুযোগ-সুবিধায় গোটা ক্যাম্পাসে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে ছাত্রলীগ।  


পাঁচ বছরে চার হত্যাকাণ্ড-১
গত পাঁচ বছরে রাবিতে ছাত্রলীগের সাথে নিজ দল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের সাথে সংঘর্ষে নিজ দলের তিন কর্মীসহ এক শিবির নেতা নিহত হয়েছে। ২০০৯ সালের ১৩ মার্চ-শের-ই-বাংলা ফজলুল হক হলের ভিতরে শিবির ও ছাত্রলীগের মাঝে সংঘর্ষ হয়। এসময় তৎকালীন ছাত্রশিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সেক্রেটারি শরীফুজ্জামান নোমানীকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ঘটনাস্থলেই হত্যা করে ছাত্রলীগের কর্মীরা। ওই ঘটনায় ক্যাম্পাস বন্ধ থাকে ৮০ দিন। 

এরপর ২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবির-ছাত্রলীগ ও পুলিশের ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে শাহ মখদুম হলের ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক হোসেন নিহত হয়। ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক হত্যার ঘটনার জের ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী মেহেরচন্ডী এলাকার শিবির নেতা শাহীনকে ১০ ফেব্রুয়ারি চাঁপাইনবাগঞ্জে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। ওই ঘটনার পর প্রশাসন, পুলিশ ও ছাত্রলীগ মিলে রাবি ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়ন করা হয় ছাত্রশিবিরকে। ২০১০ সালের ১৫ আগস্ট শোক দিবসের অনুষ্ঠান শেষে ইফতারির টোকেন ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি আওয়াল কবির জয় গ্রুপের ক্যাডাররা দলীয় কর্মী নাসিমকে মারধর ও ছুরিকাঘাতের পর শাহ মখদুম (এসএম) হলের দ্বিতীয় তলার ছাদ থেকে ফেলে দেয়। এক সপ্তাহ পর ঢামেক হাসপাতালে নাসিমের মৃত্যু হয়। এরপর ২০১২ সালের ১৫ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাদার বখ্শ হলের সামনে পদ্মা সেতুর চাঁদার টাকার ভাগ নিয়ে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে খুন হন ছাত্রলীগ কর্মী ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল হাসান সোহেল। সোহেল তৎকালীন ছাত্রলীগের শেরে বাংলা হল প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক ও সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের কর্মী ছিলেন। 

এসব হত্যাকা-ের পর থানায় এক বা একাধিক মামলা এবং নামমাত্র তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও আজ পর্যন্ত কোনো হত্যাকা-ের সুষ্ঠু বিচার হয়নি। হত্যাকা-ের পরক্ষণেই অভিযুক্তরা ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়িয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশের হর্তা-কর্তাদের সঙ্গে ওঠা-বসা করেছে।  

প্রকাশ্যে অস্ত্রবাজি
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গত পাঁচ বছরে একাধিক বার প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে প্রতিপক্ষ বা নিজ দলের নেতা-কর্মীদের উপর গুলিবর্ষণ করে ছাত্রলীগের অস্ত্রধারী ক্যাডাররা। তাদের এসব অস্ত্রের ছবি ও ভিডিও ফুটেজ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়। ২০১২ সালের ২ অক্টোবর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে শিবির-ছাত্রলীগের মাঝে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদক তৌহিদ আল তুহিন, তৎকালীন কমিটির সহসভাপতি আখেরুজ্জামান তাকিম, গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক  তানিম, উপদপ্তর সম্পাদক আতিক রহমান আতিক, উপ-পাঠাগার সম্পাদক নাসিম আহমেদ সেতুসহ বেশ কয়েকজনকে পুলিশের সামনে প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি ছুঁড়তে দেখা যায়। ওই সময় এসব বিষয় নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে তোলপাড় হয়। এরপর গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর শিবিরকে ক্যাম্পাস ছাড়া করতে পুলিশের সামনে ছাত্রলীগ ক্যাডার তানিম তাহমিদ, ফয়সাল আহমেদ রুনু, শরীফুল ইসলাম সাদ্দামসহ বেশ কয়েকজনকে শহীদুল্লাহ কলা ভবনের সামনে প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি করতে দেখা যায়। এর পরের দিন অর্থাৎ ২৩ সেপ্টেম্বর সুজনসহ তিন ছাত্রলীগ ক্যাডার অস্ত্রসহ ক্যাম্পাসের বধ্যভূমিতে পুলিশের হাতে ধরা পড়লেও রাবি ছাত্রলীগ সভাপতি মিজানুর রহমান রানা মতিহার থানায় গিয়ে তাদের ছাড়িয়ে আনেন। এরপর গত বছরের ২৮ নভেম্বর ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকের সামনে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে ছাত্রলীগের অন্তত ১০ নেতা-কর্মীর হাতে পুলিশের সামনে আগ্নেয়াস্ত্র দেখা গেছে। তারা প্রতিপক্ষকে লক্ষ্য করে ওইদিন গুলিও ছুঁড়েছে। যার চিত্র বিভিন্ন পত্রিকা ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতেও এসেছে। 


সর্বশেষ গত ২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে শিক্ষার্থীদের উপর গুলিবর্ষণ করে ছাত্রলীগ ক্যাডাররা। এরা হলেন রাবি ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ফয়সাল আহম্মেদ রুনু, যুগ্ম সম্পাদক নাসিম আহাম্মেদ সেতু, সাংগঠনিক সম্পাদক শামসুজ্জামান ইমন, পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক মুস্তাকিম বিল্লাহ, আনোয়ারুল এবং বিগত কমিটির যুগ্ম সম্পাদক সুদীপ্ত সালাম। এছাড়াও একাধিকবার ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ভয় দেখাতে বা কোনো অনৈতিক কাজ করতে এসব আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার করেছেন। পরীক্ষা কক্ষে বেঞ্চের ওপর অস্ত্র রেখে ছাত্রলীগ নেতাদের পরীক্ষা দিতেও দেখা গেছে।  


সাধারণ শিক্ষার্থীদের মারধর
গত পাঁচ বছরে অন্তত ৫ শতাধিক শিক্ষার্থীকে নির্মম নির্যাতন করে আবাসিক হল থেকে বের করে দিয়েছে ছাত্রলীগ ক্যাডাররা। ছাত্রলীগের এসব কুকর্মের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় এবং পুলিশ প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করলেও তারা কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ২০১২ সালের ১২ নভেম্বর রাবির বঙ্গবন্ধু হলে ৭ শিক্ষার্থীকে শিবির সন্দেহে রাতভর নির্যাতন করে ছাত্রলীগ। তার এক সপ্তাহ পরে, ১৯ নভেম্বর মাদার বখ্শ হলে শিবির ধরার নামে ১০ জন শিক্ষার্থীকে রাতভর মেরে হাত ও পা ভেঙ্গে দেয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এর আগের রাতেও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা অন্ততপক্ষে ৭জন সাধারণ ছাত্রকে শিবির সন্দেহে মারধর করে হল থেকে বের করে দেয় এবং কয়েকজনকে সকাল ১০টার মধ্যে হল ত্যাগের নির্দেশ দেয়। এছাড়াও ২০১৩ সালের শুরুর দিকে বিশ্ববিদ্যালয় শাহ্ মখদুম হল থেকে ২০-২৫ জন শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে হল থেকে বের করে দেয়। এর আগে ২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগ-শিবির সংঘর্ষের পর ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি, কম্পিউটার চুরি, সিট বাণিজ্য, মারধর ও হয়রানিতে অতিষ্ঠ হয়ে, ছাত্রদের ১১টি আবাসিক হল প্রশাসনের সূত্র অনুযায়ী, দুই শতাধিক শিক্ষার্থী হল ছেড়ে চলে যায়। 

ছাত্রলীগের হাতে শিক্ষক লাঞ্ছিত
চাঁদাবাজি, অবৈধ সিট দখল ও পরীক্ষার হলে বিশৃংখলার ঘটনায় বাধা দিতে গেলে ছাত্রলীগের হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, হল প্রাধ্যক্ষসহ লাঞ্ছিত হয়েছেন ২০ জনেরও অধিক শিক্ষক। পরীক্ষার হলে বিশৃংখলা সৃষ্টি করার ঘটনায় বাধা দেওয়ায় বাংলা বিভাগের আওয়ামীপন্থি শিক্ষক সফিকুন নবী সামাদীকে লাঞ্ছিত করে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ২০১০ সালের ৩০ ডিসেম্বর চাঁদাবাজির সময় বাধাদানের ঘটনায় রাবি ছাত্রলীগের উপ-গণশিক্ষা সম্পাদক এমদাদুল হক ফোকলোর বিভাগের আওয়ামীপন্থি শিক্ষক অনুপম হিরা মন্ডলকে মারধর করে। ২০১১ সালের ৭ এপ্রিল ছাত্রলীগের অবৈধ সিট দখলে বাধা দিতে গিয়ে ছাত্রলীগের সভাপতিসহ নেতাকর্মীদের হাতে লাঞ্ছনার শিকার হন শহীদ শামসুজ্জোহা হল প্রাধ্যক্ষ মুর্ত্তুজা খালেদ ও প্রক্টর। ওই ঘটনায় শিক্ষক সমিতি নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায় এবং প্রাধ্যক্ষ পরিষদ কর্মবিরতি পালন করে। ২০১২ সালের ২ অক্টোবর শিবির-ছাত্রলীগ সংঘর্ষের দিন তৎকালীন রাবি প্রক্টর চৌধুরী মোঃ জাকারিয়াসহ তিনি সহকারী প্রক্টরকে মারধর করে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। এছাড়াও বিভিন্ন সময় একাধিকবার ছাত্রলীগের হাতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ । 


রক্ষা পায়নি অর্ধশতাধিক সাংবাদিক
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হাতে গত পাঁচ বছরে অর্ধশতাধিক সাংবাদিক শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছে। ২০১০ সালের ১৫ জানুয়ারি এক শিক্ষককে লাঞ্ছিতের ছবি তুলতে গেলে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত তিন সাংবাদিক সায়েম সাবু (যুগান্তর), আকন্দ মোহাম্মদ জাহিদ (নিউজ টুডে) এবং আসাদুর রহমানকে (ফোকাস বাংলা) পিটিয়ে আহত করে। একই বছরের ১০ জানুয়ারি ছাত্রলীগ ক্যাডাররা দৈনিক দিনকাল ও অনলাইন সংবাদ সংস্থা রেডটাইমস্ বিডি ডটকম-এর সাংবাদিক মুনছুর আলী সৈকতকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে। এরপর ১১ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ক্যাম্পাসে এক সাধারণ শিক্ষার্থীকে পেটানোর সময় ছবি ও সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে ছাত্রলীগ ক্যাডাররা চ্যানেল আই’র বিশেষ প্রতিনিধি (ঢাকা থেকে আগত) মোস্তফা মল্লিক, ক্যামেরাম্যান মইন, দৈনিক আমার দেশ রাজশাহী অফিসের ফটো সাংবাদিক আসাদুজ্জামান আসাদ, প্রথম আলো’র আজহার উদ্দিন, নিউ এইজ’র সৌমিত্র মজুমদার, কালের কণ্ঠ’র নজরুল ইসলাম জুলু, সানশাইনের রুনি, জনকন্ঠের রাবি প্রতিনিধি শহিদুল ইসলাম, যুগান্তরের সায়েম সাবু ও দি এডিটরের আতিকুর রহমান তমাল ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হাতে মারধরের শিকার হন। এসময় প্রথম আলোর ফটো সাংবাদিক ও চ্যানেল আই প্রতিনিধির ক্যামেরা ভাংচুর করে ছাত্রলীগ ক্যাডাররা। ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগ কর্মীরা শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলে দৈনিক ইনকিলাব প্রতিনিধি সামসুল আরেফিন হিমেল ও বাংলাবাজার পত্রিকার শাহজাহান বিশ্বাসকে পিটিয়ে আহত করে। এর আগে ছাত্রলীগের হামলার শিকার হন শীর্ষ নিউজ’র লুৎফর রহমান, যুগান্তরের সায়েম সাবু, ডেসটিনি’র আব্দুর রাজ্জাক সুমন, বাংলাদেশ টুডে’র আওরঙ্গজেব সোহেল, আরটিএনএন’র এস এম সাগরকে। 



২০১১ সালের ৬ এপ্রিল দৈনিক নয়া দিগন্তের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি শামছুল ইসলাম কামরুল এবং দৈনিক নতুন প্রভাত ও অনলাইন সংবাদ সংস্থা বিডি ন্যাশনাল নিউজ’র রহিদুল ইসলাম নীরবকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর চৌধুরী মো. জাকারিয়ার নেতৃত্বে সহকারী প্রক্টর ও নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত সরকার দলীয় কয়েকজন শিক্ষককে সহস্রাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সামনে পিটিয়ে আহত করে। এছাড়া সাংবাদিক সমিতির সভাপতি ও ডেইলি স্টারের সাংবাদিক আকন্দ মোহাম্মদ জাহিদ ও সাধারণ সম্পাদক ডেইলি সান’র প্রতিনিধি সোহেল রানা যুবলীগ কর্মী ও দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার হন। এবছরের ১২ জুলাই ছাত্রলীগ কর্মী মাসুদ ওরফে ভাগ্নে মাসুদ, আসাদ, মাহাবুবসহ ৪/৫ জন ছাত্রলীগ কর্মী দৈনিক ইনকিলাবের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি আজিবুল হক পার্থকে পিটিয়ে আহত করে। এরপর ২ আগস্ট ছাত্রলীগের হামলার শিকার হন দৈনিক জনতা’র রিপোর্টার আকিব জাভেদ। এছাড়াও সৈয়দ আমীর আলী হলে ককটেল উদ্ধারের সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে রাজশাহীর স্থানীয় দৈনিক লালগোলাপ’র প্রতিনিধি সরদার হাসান ইলিয়াস তানিসের উপর হামলা চালায় ছাত্রলীগের চিহ্নিত ক্যাডাররা। এর পর ২০১৩ সালের শেষের দিকে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে নিউজ করার কারণে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে দৈনিক ইনকিলাবের রাবি প্রতিনিধি আজিবুল হক পার্থ, অর্থনীতি প্রতিদিনের আল-আমীন হোসেন আকাশ ও নাজিম মৃধাকে। 



শতাধিক সংঘর্ষে আহত পাঁচ শতাধিক
আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত পাঁচ বছরে রাবি ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যে এবং প্রতিপক্ষ গ্রু’পের সাথে শতাধিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসব সংঘর্ষে কমপক্ষে পাঁচ শতাধিক ছাত্র আহত হয়েছে। বিভিন্ন প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, উল্লেখযোগ্য সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে ২০০৯ সালে ২৩টি, ২০১০ সালে ২৯টি, ২০১১ সালে ২১টি, ২০১২ সালে ২০টি এবং ২০১৩ সালে ১০টি। এছাড়াও ক্যাম্পাসে আরও অনেকগুলো ছোট-খাটো সংঘর্ষ ঘটেছে। 

ছিনতাই-চাঁদাবাজি
বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিপক্ষ বা নিজ দলের নেতা-কর্মীদের সাথে বিভিন্ন সময় সংঘর্ষে ব্যবহৃত অস্ত্র দিয়েই ক্যাম্পাসের আবাসিক হল ও কয়েকটি নির্দিষ্ট পয়েন্টে দীর্ঘ দিন ধরে ছিনতাই করে আসছে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা। বিশ্ববিদ্যালয় শাহ্ মখ্দুম, সৈয়দ আমীর আলী, মাদার বখ্শ হলসহ বেশ কয়েকটি আবাসিক হল থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় জুবেরী মাঠ, প্যারিস রোড, পুরাতন ফোকলোর মাঠ, তুঁতবাগান, হবিবুরের মাঠসহ বেশ কয়েকটি স্পটেও ছাত্রলীগ ক্যাডাররা এসব ছিনতাই করে থাকে। এক রিক্সাচালক মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে আড়াইশ’ টাকা ছিনতাই করে ছাত্রলীগ নেতা ডেবিল। তবে সম্প্রতি ছাত্রলীগের নতুন কমিটি গঠনের পর চাঁদাবাজির হার কিছুটা কমেছে বলে জানা গেছে।  

সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মিজানুর রহমান রানা বলেন, এই প্রাণের ক্যাম্পাসে শিবির ক্যাডাররা একাধিকবার আমাদের নেতাকর্মীদের রক্ত ঝরিয়েছে। তাদের রগকাটার রাজনীতির শিকার হয়েছেন আমাদের একাধিক নেতা। সুতরাং তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। 


শিবিরের সভাপতি আশরাফুল আলম ইমন বলেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী হামলা ও প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি প্রমাণ করে তারা কিসের রাজনীতি করে। তিনি মতিহারের সবুজ ক্যাম্পাসে শিক্ষার শান্ত পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর আহ্বান জানান রাবি প্রশাসনের কাছে। 


ছাত্রদলের আহ্বায়ক আরাফাত রেজা আশিক বলেন, অস্ত্রধারী যেই হোকনা কেনো তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আহ্বান জানিয়েছি। ছাত্রলীগের চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনার জোর দাবি জানান তিনি। 


বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মিজান উদ্দিন বলেন, সন্ত্রাসীদের কোনো দল নেই। আমাদের দৃষ্টিতে সবাই সমান। আইন অনুুযায়ীই এসব ঘটনার সাথে জড়িতদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে। 

উল্লেখ্য, বর্ধিত ফি ও সান্ধ্যকালীন কোর্স বাতিলের দাবিতে রোববার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ভবনের সামনে সমাবেশ চলাকালে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ ও পুলিশ সশস্ত্র হামলা চালায়। ৩০ জন গুলিবিদ্ধসহ অন্তত শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়। এ ঘটনার কারণে জরুরি সভায় সিন্ডিকেট বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। এই মাসে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার কোনো সম্ভাবনা নেই বলেও জানা গেছে।

No comments:

Post a Comment