সেদিন ফেসবুকে দেখলাম একজন লিখেছেন "ছাত্রলীগ লিখে গুগলে সার্চ দেন, তারপরে দেখেন"! কৌতূহলী হয়ে দিলাম সার্চ, যা ভাবছিলাম ঠিক তাই, অর্থাৎ ছাত্রলীগের নানান সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের খবর। আসলেই এখন ব্যাপারটা অনেকটা তেমনই দাঁড়িয়েছে। ছাত্রলীগ এবং সন্ত্রাস-খুন-টেন্ডার বাজি সমার্থক শব্দ হয়ে গেছে প্রায়, যেমন হয়েছিল চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ছাত্রদল। প্রায় প্রতিটা দিন পত্রিকার পাতায় ছাত্রলীগের এমন কর্মকাণ্ড নিয়ে নিউজ থাকেই। সাধারণ পাবলিকের একটা বিতৃষ্ণা এসে গেছে ছাত্র রাজনীতির উপরে। অথচ আমাদের প্রায় সব গৌরবজনক অর্জনের সাথে ছাত্র সমাজ বা ছাত্র রাজনীতির ভূমিকা স্বর্ণালী অক্ষরে লেখা রয়েছে। কিছুদিন আগে ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে হত্যা করে বিশ্বজিতকে যা মিডিয়ার কল্যাণে আমরা টিভিতে দেখেছি, দেশে বিদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় এই ঘটনার পরে। এখন ছাত্রলীগ প্রসঙ্গে কিছু বলতে গেলেই প্রথমে চলে আসে বিশ্বজিত হত্যাকাণ্ডের কথা। কিন্তু আমি মনে করি সেদিনের ঐ হত্যাকাণ্ডের ভিডিও চিত্র ধারণ করা সম্ভব না হলে ঐ হত্যাকাণ্ড নিয়ে কারও কোন মাথা ব্যথা থাকতো না। দেশে আনাচে কানাচে এমন অনেক বিশ্বজিতদের প্রাণ দিতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কই সেসব নিয়ে তো তেমন কোন কথা হয় না।
যাই হোক, আমার লেখার উদ্দেশ্য ছাত্রলীগ বা বিশ্বজিত হত্যাকাণ্ড নয়, বর্তমানে ছাত্র রাজনীতির নেতিবাচক প্রচারণা প্রসঙ্গে। কখনও ছাত্রলীগ কখনও বা ছাত্রদলের কারণে সাধারণ পাবলিক যখন অতিষ্ঠ ছাত্র রাজনীতি প্রসঙ্গে, তখন ছাত্র রাজনীতির একজন প্রাক্তন কর্মী হিসেবে বর্তমান হাল হকিকত পর্যবেক্ষণ করে আমার কাছে মনে হয়, বর্তমানে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিগত তিনটি দশকের তুলনায় অনেক অনেক ভালো পরিবেশ রয়েছে। আগেই বলে রাখি এটা একান্তই আমার নিজের চিন্তা ভাবনা। তবে এই কথা বলার জন্য আমাকে পাগল ভাবলে সম্ভবত ভুল হবে। এই প্রসঙ্গে আশির দশকের জনপ্রিয় ব্যান্ডদল "চাইম" এর একটা গানের কথা মনে পড়লো, যেই গানে সেই সময়ের ছাত্র রাজনীতির একটা চিত্র ফুটে ওঠে। ঐ গানের কয়েকটা লাইন ছিল -
অনার্স কোর্স তিন বছরলাগে মাত্র ছয় বছরবাবার পকেটে লালবাতি জ্বলেহায় মধুর পরিবেশহলের ডালে জীবন শেষপাস কোর্সে এ্যাটেন্ড করা ভালোএ কেমন অভিশাপ বলো।
হ্যাঁ, এখনও সেশন জট রয়েছে, কিন্তু নির্দ্বিধায় বলা যায় আশি এবং নব্বইয়ের দশকের তুলনায় তা অনেকটা কম। অনির্ধারিত ছুটি এখনও দেয়া হয় তবে সেটাও ২০ বছর আগের মতো মহামারির আঁকার ধারণ করেনা। মনে করতে পারছি ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পরে ঐ বছর জুন থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে দেশের শতাধিক শীর্ষস্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ছাত্র সংঘর্ষের জের ধরে। সেই সময়ের সংঘর্ষগুলো হতো বর্তমানের চাইতে অনেক অনেক বেশী ভয়াবহ। দেশের প্রধান দুই বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক দিনেই যথাক্রমে ৪০০ এবং ১০০০ রাউন্ড গুলি বর্ষণের মতো ঘটনাও অতীতে ঘটেছে। এখন মিডিয়ার কল্যাণে অনেক স্থিরচিত্র বা ভিডিও আমরা দেখছি এবং শিউরে উঠছি। কোন ঘটনায় ছোড়া হাতে থাকা কোন যুবকের ছবি বৃত্ত এঁকে মার্ক করে দেয়া হচ্ছে পত্রিকার পাতায়। পাইপ গান বা পিস্তল বিভলবার হলে তো কথাই নেই। কিন্তু আজ থেকে ২৫ বছর আগে মিডিয়ার এতো সুযোগ সুবিধা থাকলে ছোড়া-রিভলবার-নাইন এমএম এর বদলে কাঁটা রাইফেল, কাঁটা বন্দুক, এলএমজি, শটগান, চাইনিজ রাইফেল বা জি থ্রি রাইফেলধারীদের ছবি হর হামেশাই দেখা যেতো। সেই সময়টা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হাত বাড়ালেই পাইপ গান, সিঙ্গেল শুটার, শাটার গান, এলজি'র দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া যেতো। অনেক কথা বলে ফেললাম। লেখার পরিধি বড় হয়ে গেলো। মূল প্রসঙ্গে যাই।
দেশের শুধুমাত্র একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের পেশী শক্তি নির্ভর ছাত্র রাজনীতির দিকে দৃষ্টি দিলেই বুঝা যাবে আমি কেন বলছি বর্তমান সময়ে শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ অতীতের যে কোন সময়ের থেকে অনেক ভালো। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে খ্যাত, বাংলাদেশের সকল প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ স্বাধীনতার পর থেকে ঢাবি ক্যাম্পাসে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের অন্তত ৬০ নেতাকর্মী খুন হয়েছেন। সরকার বিরোধী আন্দোলন, ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তার, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, চাঁদাবাজির টাকা ভাগবাটোয়ারা করা নিয়ে মুখোমুখি বন্দুক যুদ্ধে এবং কিছু ক্ষেত্রে পরিকল্পিতভাবে এসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। শুধু শিক্ষার্থীই নয় খুন হয়েছে একাধিক কর্মচারী ও বহিরাগতও।
সদ্য স্বাধীন দেশে অনেকের কাছেই আগ্নেয়াস্ত্র থাকা স্বত্বেও সত্তুরের দশকের এর ব্যবহার খুব একটা দেখা যায়নি ঢাবি ক্যাম্পাসে। তবে পচাত্তরের পট পরিবর্তন এবং সামরিক শাসক জেনারেল জিয়ার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই বৃদ্ধি পেতে অস্ত্রের অব্যবহার। বিশেষ করে আশির দশকে ছাত্রদলের মাধ্যমে সম্পূর্ণ পেশী শক্তি নির্ভর ছাত্র রাজনীতির একটা ধারার সৃষ্টি হয়। দেশব্যাপী প্রতিটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আধিপত্য বিস্তারে ব্যাপকহারে শুরু হয় অস্ত্রের ব্যবহার। শুধু প্রতিদ্বন্দ্বী অন্যান্য সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধেই নয় নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বেও অস্ত্রের ব্যবহার ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়।
সে সময় "সন্ত্রাস যদি শিল্প হয়, আমি সেই শিল্পের সার্থক শিল্পী" উক্তি করে সন্ত্রাস নির্ভর ছাত্র রাজনীতির মডেল বনে যাওয়া ঢাবির কুখ্যাত সন্ত্রাসী গোলাম ফারুক অভি, সানাউল হক নীরু ও নতুন বাংলা ছাত্র সমাজ থেকে ছাত্রদলে আসা ইলিয়াস আলীর নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অভি-নীরু গ্রুপ এবং ইলিয়াস গ্রুপ নামে পরস্পর বিরোধী দুটি গ্রুপের উত্থান ঘটে।
সে সময় "সন্ত্রাস যদি শিল্প হয়, আমি সেই শিল্পের সার্থক শিল্পী" উক্তি করে সন্ত্রাস নির্ভর ছাত্র রাজনীতির মডেল বনে যাওয়া ঢাবির কুখ্যাত সন্ত্রাসী গোলাম ফারুক অভি, সানাউল হক নীরু ও নতুন বাংলা ছাত্র সমাজ থেকে ছাত্রদলে আসা ইলিয়াস আলীর নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অভি-নীরু গ্রুপ এবং ইলিয়াস গ্রুপ নামে পরস্পর বিরোধী দুটি গ্রুপের উত্থান ঘটে।
উভয় গ্রুপের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংঘর্ষ ঘটেছে বহুবার। নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার সন্ত্রাসীদের এনে হলে তোলে উভয় গ্রুপই। এই সময়েই ক্যাম্পাসে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়। ইলিয়াস গ্রুপ ও অভি-নীরু গ্রুপের বন্দুক যুদ্ধ, সংঘর্ষ, বোমাবাজি রীতিমতো নিয়মিত ব্যাপার হয়ে যায়। ঘটতে থাকে একের পর এক হত্যাকাণ্ড।
ক্যাম্পাসে মোট চারটি সংগঠনকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার জন্য অভিযুক্ত করা যায় নিঃসন্দেহে। ছাত্রদল, জাসদ ছাত্রলীগ, নতুন বাংলা ছাত্র সমাজ এবং আওয়ামী ছাত্রলীগ। অবশ্য আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে এরশাদ নতুন বাংলা ছাত্র সমাজকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে।
ক্যাম্পাসে মোট চারটি সংগঠনকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার জন্য অভিযুক্ত করা যায় নিঃসন্দেহে। ছাত্রদল, জাসদ ছাত্রলীগ, নতুন বাংলা ছাত্র সমাজ এবং আওয়ামী ছাত্রলীগ। অবশ্য আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে এরশাদ নতুন বাংলা ছাত্র সমাজকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে।
বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় এসময়। একেকটা হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একটা করে তদন্ত কমিটি গঠন করে দায়িত্ব শেষ করেছে, আজ পর্যন্ত সেসব তদন্ত কমিটির কোন প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। সেখানে বিচার হওয়া তো অনেক দূরের কথা। অবশ্য একটা হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছিল এবং ১৯৮৭ সালে এক ছাত্র সংঘর্ষের জের ধরে ঢাবি কর্তৃপক্ষ জাসদ ছাত্রলীগ এবং জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ১২ জন নেতা কর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করেছে।
১৯৭২ সালের ডাকসু নির্বাচন এবং ছাত্রলীগ বিভক্ত হওয়ার পূর্বে এবং পরে একাধিকবার ক্যাম্পাসে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলেও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ঢাবিতে প্রথম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ১৯৭৪ সালে। এবারে দেখা যাক ঢাবি ক্যাম্পাসে স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত ঘটা হত্যাকাণ্ডের কিছু বিবরণ -
সেভেন মার্ডার, ৪ এপ্রিল ১৯৭৪ : ১৯৭৪ সালের ৪ এপ্রিল প্রথম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এদিন সংঘটিত হয় এক নির্মম হত্যাকাণ্ড। যা ঢাবির ইতিহাসে কুখ্যাত সেভেন মার্ডার নামে খ্যাত। সেদিন অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে মুজিববাদী ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলমসহ প্রায় ১৫ জনের একটি সশস্ত্র গ্রুপ রাত আনুমানিক দেড়টার দিকে সূর্যসেন হলের ৬৪৫ ও ৬৪৮ নম্বর কক্ষ থেকে ৭ জন ছাত্রকে তুলে নিয়ে যায় মুহসীন হলে। পরে মুহসীন হলের টিভি রুমের সামনের করিডোরে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হয় তাদের। সেদিন যারা নিহত হয়েছেন তারা হলেন -
১। রেজওয়ানুর রব (প্রথম বর্ষ, সমাজবিজ্ঞান) ২। সৈয়দ মাসুদ মাহমুদ (প্রথম বর্ষ, সমাজবিজ্ঞান) ৩। এবাদ খান (প্রথম বর্ষ, সমাজবিজ্ঞান) ৪। নাজমুল হক (সমাজবিজ্ঞান) ৫। আবুল হোসেন (প্রথম পর্ব, সমাজবিজ্ঞান) ৬। মোহাম্মদ ইদ্রিস (এমকম, প্রথম পর্ব) এবং ৭। বশিরুদ্দিন আহমদ জিন্নাহ (প্রথম পর্ব, এমকম)।
সরকার প্রধানের নির্দেশে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে মুজিববাদী ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধানসহ তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। বিচারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয় শফিউল আলম প্রধানকে। এই দীর্ঘ সময়ে এতোগুলো হত্যাকাণ্ডের মধ্যে শুধুমাত্র এই একটি হত্যাকাণ্ডেরই বিচার হয়েছে। তবে পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পরে জিয়া ক্ষমতায় আসলে মুক্তি পেয়ে যান তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সৈনিক হিসেবে। তখন থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের মাটিতেই নির্বিঘ্নেই রাজনীতি করে যাচ্ছেন ১৮ দলীয় জোটের অন্যতম শরীক জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) প্রধান শফিউল আলম প্রধান।
১২ এপ্রিল, ১৯৭৮ : রোকেয়া হলের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী ও তাদের সমর্থক ছাত্রীদের সঙ্গে অপর ছাত্রীদের মতবিরোধের জের ধরে কর্তৃপক্ষ তিন ছাত্রীর সিট বাতিল করে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরস্পরবিরোধী দুই পক্ষ ক্যাম্পাসে মিছিলের প্রস্তুতি চালানোর সময় সংঘর্ষ বাধে। এ ঘটনার জের ধরে রেজিস্টার বিল্ডিংয়ের ১২৭ নম্বর কক্ষে এক ছাত্র নিহত হয়। নিহত এই ছাত্রের নাম প্রকাশ করেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, সম্ভবত সরকারের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে চাপ প্রয়োগ করা হয়।
১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৩ : ১৯৭৭ সাল থেকে একাত্তরে স্বাধীনতা বিরোধী মূল দল জামাতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ নাম পরিবর্তন করে শিবির নাম ধারণ করে এবং রাজনীতি করার সুযোগ পায় তৎকালীন সেনা সরকারের ছত্র ছায়ায়। শিবিরের ষষ্ঠ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে তারা একটি র্যালী বের করার চেষ্টা করে। কিন্তু র্যালীটি কলা ভবনের পশ্চিম গেট এলাকায় আসা মাত্র সাধারণ শিক্ষার্থী এবং মধুর ক্যান্টিনে অবস্থানরত সংগ্রাম পরিষদের নেতা কর্মীরা সেই মিছিলে হামলা করে। এতে এক জনের মৃত্যু (নাম প্রকাশিত হয়নি) হয়। এই ঘটনার পরে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার্থে সরকারী এক প্রেসনোটের মাধ্যমে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা ও সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়।
১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৩ : সকল প্রকার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারী করা হলেও পরদিন ১৪ ফেব্রুয়ারি কুখ্যাত মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিলের দাবীতে ১৪টি ছাত্র সংগঠন নিয়ে গড়ে ওঠা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তাদের পূর্ব নির্ধারিত সমাবেশ ও স্মারকলিপি প্রদানের জন্য ক্যাম্পাস থেকে হাজারো ছাত্র ছাত্রীর একটা মিছিল নিয়ে সচিবালয় অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। মিছিলটি হাইকোর্ট এলাকায় পৌঁছলে মিছিলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পেটোয়া পুলিশ বাহিনী। নিরস্ত্র ছাত্র ছাত্রীদের ওপর পুলিশ লাঠি, টিয়ারগ্যাস, জল কামান ব্যবহার করেই ক্ষান্ত হয়নি, গুলিও চালায়। গোটা এলাকা রণক্ষেত্রে রূপান্তরিত হয়। একসময় শিশু একাডেমীতে শিশুদের একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছিলো। পুলিশ সেখানেও হামলে পরে। কোমল মতি শিশুরাও সেদিন রক্ষা পায়নি এরশাদের পেটোয়া বাহিনীর হাত থেকে। প্রায় সারা দিনব্যাপী এই অসম সংঘর্ষে জাফর, জয়নাল, দীপালী সাহা, আইয়ুব, ফারুক, কাঞ্চন প্রমুখ নিহত হন। দশ জনের মৃত্যুর কথা দাবী করে সংগ্রাম পরিষদ। কিন্তু সরকারি প্রেসনোটে বলা হয় ১ জনের নিহত হয়েছে।
তবে পুলিশ দিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি, ব্যাপক ছাত্র গণআন্দোলনের মুখে ১৭ ফেব্রুয়ারি তারিখে এরশাদ বলতে বাধ্য হয় যে- "জনগণের রায় ছাড়া শিক্ষা সম্পর্কে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না।" জাফর, জয়নাল, দীপালী সাহা, আইয়ুব, ফারুক, কাঞ্চনদের তাজা রক্তে রচিত হয় মধ্য ফেব্রুয়ারীর ইতিহাস। তখন থেকেই ছাত্র সমাজ ১৪ ফেব্রুয়ারী স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করে আছে।
১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৫ : ১৯৮৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারী রাত এগারোটার দিকে "মধ্যই ফেব্রুয়ারি" (১৪ ফেব্রুয়ারী স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস) পালনের প্রস্তুতি হিসেবে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের একটি মিছিল সূর্যসেন হল, মহসীন হল হয়ে জহুরুল হক হল ও এফ রহমান হলের মধ্যবর্তী সড়কে ওঠার মূহুর্তেই এফ রহমান হল থেকে মিছিলে কাটা রাইফেলের গুলিবর্ষণ করে সরকার সমর্থক ‘নতুন বাংলা ছাত্র সমাজ’র সন্ত্রাসীরা। এসময় বাকশাল সমর্থিত জাতীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক, সমাজবিজ্ঞান শেষ বর্ষের ছাত্র রাউফুন বসুনিয়া গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য শেখ হাসিনা, বেগম জিয়া এবং জাসদের কাজী আরেফ আহমেদ সরকারি মদদপুষ্ট পেটোয়া বাহিনীকে দায়ী করেন। তবে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্রদল সরাসরি দায়ী করে নতুন বাংলা ছাত্র সমাজকে। রাউফুন বসুনীয় শহীদ হওয়ার পর থেকেই ক্যাম্পাস বিশেষ করে এফ রহমান হল থেকে বিতাড়িত হয় নতুন বাংলা। সরকার দলীয় নতুন বাংলার মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দখলের চেষ্টা ব্যর্থ হলে এরশাদ নতুন বাংলা ছাত্র সমাজের বিলুপ্ত ঘোষণা করে।
এর প্রতিবাদে এবং হত্যাকারীদের বিচারের দাবীতে ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মহানগরীতে অর্ধদিবস হরতাল আহ্বান করে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। এখন কি এমন চিন্তা করা যায়? মারা গেলেন বাকশাল সমর্থিত জাতীয় ছাত্রলীগ নেতা আর তাঁর হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবী করে হরতাল আহ্বান করলো ছাত্রদল!!
২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৬ : একুশের প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে বঙ্গবন্ধু, কর্নেল তাহের এবং জিয়াউর রহমানের ছবি টানানো নিয়ে মুজিববাদী ছাত্রলীগ, জাসদ ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ব্যাপক গোলাগুলির এক পর্যায়ে বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা যান সোহরাব হোসেন নামের একজন। নিহত সোহরাবের পরিবারের পক্ষ থেকে দায়ের করা মামলায় আসামী করা হয় ছাত্রদলের নেতা কর্মীদের। উল্লেখ্য, ঐ সময়টাতে প্রায় প্রতিটি জাতীয় দিবসে সবার উপরে নিজ সংগঠনের নেতার ছবি টানানো নিয়ে এই তিন সংগঠনের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতো।
৩১ মার্চ, ১৯৮৬ : ১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়া না নেয়া ইস্যুতে বিভক্ত হয়ে যায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। আওয়ামীলীগ, বাকশাল, শাহজাহান সিরাজের নেতৃত্বাধীন জাসদ, সিপিবিসহ আটটি দল এরশাদের অধীনে নির্বাচনে গেলে ১৫ দল থেকে কাজী আরেফ আহমেদ ও হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাসদ, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বাসদসহ পাঁচটি দল বেরিয়ে এসে পাঁচ দলীয় ঐক্যজোট গঠন করে এবং নির্বাচন বর্জন করে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন সাত দলীয় জোটও নির্বাচন বর্জন করে। পাঁচ দল এবং সাত দল সমর্থিত ছাত্র সংগঠনগুলো নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়। এমনই এক উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে ৩১ মার্চ নির্বাচনের সমর্থনে ক্যাম্পাসে মিছিল বের করে ছাত্র ইউনিয়ন। মিছিলটি জগন্নাথ হল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির সামনে দিয়ে কলা ভবন প্রদক্ষিণ করে লেকচার থিয়েটারের পশ্চিম গেটে পৌঁছলে সূর্যসেন হল থেকে মিছিলের উপরে সশস্ত্র হামলা চালায় ছাত্রদল, জাসদ ছাত্রলীগ সহ নির্বাচন বয়কটপন্থিরা। এতে ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী আসলাম মাথায় গুলিবিদ্ধ হন, রাইফেলের গুলিতে তাঁর মাথার খুলি উড়ে যায় এবং ঘটনাস্থলের নিহত হন তিনি।
৮ ও ৯ মার্চ, ১৯৮৭ : এদিন দুপুরের দিকে হাজী মুহসীন হলের ৪২৬ নম্বর কক্ষে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে প্রকম্পিত হয়ে উঠে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। শক্তিশালী বোমার বিস্ফোরণে গুরুতর আহত হনছাত্রদলের তৎকালীন প্রভাবশালী নেতা মাহবুবুল হক বাবলু ও তার দুই সহযোগী মইন উদ্দিন এবং নূর মোহাম্মদ। গুরুতর আহত বাবলুকে হাসপাতালে নেয়ার পথেই তাঁর মৃত্যু হয়। অপর দিকে পিজিতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মইনউদ্দিন ও নূর মুহাম্মদও মারা যান পরের দিন ০৯ মার্চ। উল্লেখ্য, নিহত বাবলু ছাত্রদলের অপর প্রভাবশালী নেতা সানাউল হক নীরুর আপন সহোদর ছিলেন।
১৪, ১৫ ও ১৯ জুলাই, ১৯৮৭ : আধিপত্য বিস্তার ও সূর্যসেন হলের একটা রুমের দখল নেয়াকে কেন্দ্র করে ১৯৮৭ সালের ১৪ জুলাই ভয়াবহ সংঘর্ষে লিপ্ত হয় ছাত্রদল ও জাসদ ছাত্রলীগের কর্মীরা। দুই পক্ষের বন্দুক যুদ্ধে সূর্যসেন হলের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ইতিহাস বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছাত্রদল কর্মী আবদুল হালিম। এই ঘটনার জের ধরে পরের দিন অর্থাৎ ১৫ জুলাই রণক্ষেত্রে পরিণত হয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। ছাত্রদল ও জাসদ ছাত্রলীগের কর্মীদের মধ্যে মারাত্মক এই বন্দুক যুদ্ধে কয়েকশত রাউন্ড গুলি বিনিময় হয় উভয় পক্ষের মধ্যে। মুহুর্মুহু গুলির শব্দে প্রকম্পিত হয় ঢাবি ক্যাম্পাস। এই সংঘর্ষে উভয় পক্ষই চাইনিজ রাইফেল, জি থ্রি রাইফেলের মতো অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে। এতে পথচারী কামরুল হাসান এবং রিকশাচালক আব্দুর রহিম গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন ভূতত্ত্ব ও খনিজ বিদ্যা বিভাগের ছাত্র শহীদুল্লাহ হলেরজাসদ ছাত্রলীগ নেতা আসাদ আহমেদ মুন্না। তিন দিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে ১৯ জুলাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান এসএসসি ও এইচএসসিতে স্ট্যান্ড করা মেধাবী ছাত্র মুন্না।
ভয়াবহ এই সংঘর্ষের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্রদলের নয় জন এবং জাসদ ছাত্রলীগের তিনজন ছাত্রকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে সেপ্টেম্বর মাসে। বহিষ্কৃতদের মধ্যে কয়েক জন হচ্ছেন - গোলাম ফারুক অভি, সানাউল হক নীরু, বজলুর রশিদ শহীদ ওরফে পাগলা শহীদ, প্রায় এক বছর ধরে নিখোঁজ বিএনপির সাবেক সাংসদ ও ঢাবির কুখ্যাত ছাত্রদল নেতা এম ইলিয়াস আলী এবং জাসদ ছাত্রলীগের আবু হাসান মুরাদ, আকরাম ও শিপন। বহিষ্কৃতদের মধ্যে ছাত্রদলের পাগলা শহীদ (১৯৮৮) এবং জাসদ ছাত্রলীগের আবু হাসান মুরাদ পরে (১৯৯৩) প্রতিপক্ষের হাতে খুন হন।
১১ ডিসেম্বর, ১৯৮৮ : ক্যাম্পাসে বিএনপি নেত্রীর উপস্থিতি ১১ ডিসেম্বর রাতে ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে মুহসীন হলের ৩৫৭ নং কক্ষে মাথায় গুলিবিদ্ধ হন পাঁচ মাস আগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত ছাত্রদলের অন্যতম নেতা বজলুর রহমান শহীদ ওরফে পাগলা শহীদ।বুলেটবিদ্ধ পাগলা শহীদকে পিজি হাসপাতালে নেওয়ার পর তিনি মারা যান। উল্লেখ্য, যখন এই ঘটনা ঘটে তখন বেগম জিয়া জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের জিয়া হল শাখার সম্মেলনে বক্তব্য রাখছিলেন। রাত ৯ টায় শহীদের গুলি বিদ্ধ হওয়ার সংবাদে দ্রুত বক্তব্য শেষ করে সাড়ে ৯টার দিকে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন বেগম জিয়া। এই হত্যাকাণ্ডের সাথে ইলিয়াস আলীর সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৯ : ডাকসু নির্বাচনে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সুলতান মনসুর-মুশতাক হোসেন-নাসিরুদ্দোজা প্যানেল জয়ী হলে ৯ ফেব্রুয়ারী ক্যাম্পাসে বিজয় মিছিল বের করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। কিন্তু নির্বাচনে পরাজিত ছাত্রদলের সন্ত্রাসীরা ঐ মিছিলে হামলা করলে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কর্মী ওজাসদ ছাত্রলীগের নেতা কফিল উদ্দিন কনক নিহত হন। আহত হন জাসদ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেত্রী ও রোকেয়া হলের তৎকালীন ভিপি সামসুন্নাহারসহ অনেকে। ছাত্রদলের সন্ত্রাসীরা এদিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিছিলে থাকা ছাত্রীদের বেধড়ক মারধোর করে। এ ঘটনায় সিন্ডিকেটের এক জরুরি সভায় ৭ দিনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
২৯ ডিসেম্বর, ১৯৮৯ : ২৯ ডিসেম্বর ফিন্যান্সের মেধাবী ছাত্র আরিফ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন আরিফ। কোন দলীয় সমর্থক না হলেও তাঁকে জীবন দিতে হয়। এস এম হলের ছাত্র আরিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটা পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণী পেয়েছিলেন। এরশাদ শাসনামলের শেষ পর্যায়ে ঢাবি ক্যাম্পাসে বেশ কয়েকটা হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সাথে সরকারের বিশেষ বাহিনীর হাত ছিল বলেও অনেকে বলে থাকেন। এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কেও সরকারের বিশেষ বাহিনীর নাম আসে। এসময় কমপক্ষে দুইটি হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে এমন অভিযোগ তোলেন সেই সময়ের ছাত্র নেতৃবৃন্দ। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনকে ডাইভারট করতেই এমন করা হয় বলে মনে করেন ছাত্রনেতাদের অনেকেই।
২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯০ : এই দিন অর্থাৎ নব্বই সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে সূর্য সেন হলে আলমগীর কবীর নামে একজনের মৃত্যু হয়।
২৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯০ : ১৯৯০ সালে একুশের প্রথম প্রহরে খালেদা জিয়া র্যালী নিয়ে পুষ্পমাল্য অর্পণের জন্য শহীদ মিনার যাওয়ার পথে ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত জহুরুল হক হল এলাকা থেকে র্যালীতে বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি চালানো হয়। বিএনপি এবং ছাত্রদল এই ঘটনার জন্য ছাত্রলীগকে দায়ী করে। খালেদা জিয়ার র্যালীতে গুলির ঘটনায় বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে ছাত্রদলের নেতা কর্মীরা। পর পর কয়েক দিন ক্যাম্পাসে এবং মুহসীন হল, সূর্যসেন হল ও জহুরুল হক হল এলাকায় সশস্ত্র অবস্থান নেন ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল। চতুর্থ দিনের দিন ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ মধুর ক্যান্টিনে মুখোমুখি হলে ছাত্রদলের কর্মীরা ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে স্লোগান দিলে দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ উভয় পক্ষকে ছত্রভঙ্গ করতে চাইলে শুরু হয় পুলিশ ছাত্রদল এবং ছাত্রলীগ কর্মীদের মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষ। এসময় বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব ভবনের পাশে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান জহুরুল হক হল ছাত্র সংসদের ভিপি শহীদুল ইসলাম চুন্নু। সেই সময়ে ঢাবি ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা ছিলেন চুন্নু। মূলত তাঁকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতো আওয়ামী ছাত্রলীগের প্রভাব বিস্তারের রাজনীতি।
এই হত্যাকাণ্ডের জন্য ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে ছাত্রদলকে দায়ী করা হলেও তৎকালীন ছাত্রনেতাদের অনেকেই এই ঘটনার পিছনে সরকারের বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার অদৃশ্য হাতের প্রতি ইঙ্গিত করেন। ওইদিনই এফএইচ হলে শাহীন নামে আরেক ছাত্রের লাশ উদ্ধার হয়। বরাবরের মতো এই ঘটনা তদন্তেও কমিটি গঠন করা হয় সিন্ডিকেট সভায়। পাশাপাশি রাষ্ট্রপতি এরশাদের সভাপতিত্বে একটি সভায় সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারকের ওপর বিচার বিভাগীয় তদন্ত পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। বলাই বাহুল্য কোন তদন্ত কমিটির রিপোর্টই আজ পর্যন্ত জানা যায়নি।
২৬ নভেম্বর, ১৯৯০ : এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে বিশেষ করে ১৯ নভেম্বর তিন জোটের রূপরেখা ঘোষিত হওয়ার পরে সর্ব দলীয় ছাত্র ঐক্যে ফাটল ধরানোর কৌশলের অংশ হিসেবে দীর্ঘ দিন ধরে কারাবন্দী অস্ত্রসহ গ্রেফতার হওয়া সানাউল হক নীরু ও গোলাম ফারুক অভিকে মুক্তি দেয় সরকার। সরকারের উদ্দেশ্য যে সর্ব দলীয় ছাত্র ঐক্যে বিভক্তি সৃষ্টি করা তা বুঝতে পেরে ২৩ নভেম্বর সানাউল হক নীরুসহ পাঁচ জন ছাত্রদল নেতাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রদল। এই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবীতে ছাত্রদলের অভি সমর্থকরা বিক্ষোভ করে এবং ডাকসু ভবনে হামলা চালিয়ে ভাংচুর করে। ডাকসুর তৎকালীন ভিপি আমানুল্লাহ আমান এবং খায়রুল কবীর খোকনকে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে অভি নীরুর সমর্থকরা। এদিন ছাত্রদলের একটা মিছিলে গুলি বর্ষণ করে অভি-নীরু গ্রুপ। পরের দিন অর্থাৎ ২৪ নভেম্বর মূল ধারা ছাত্রদল এবং ছাত্রদলের অভি-নীরু গ্রুপের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় ঢাবি ক্যাম্পাস। সংঘর্ষ ছড়িয়ে পরে হলে হলে। অনেক রুম ভাংচুর করা হয় উভয় পক্ষ থেকে। পরদিন ২৫ নভেম্বর একটা সাদা এ্যাম্বুলেন্সে করে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে অভি-নীরু গ্রুপ। এদিন তারা সর্ব দলীয় ছাত্র ঐক্যের মিছিলে গুলি বর্ষণ করলে প্রতিরোধ গড়ে তোলে সাধারণ শিক্ষার্থী, শিক্ষক কর্মচারীসহ ছাত্র ঐক্য। অবশেষ তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা সূর্য সেন হলের নিয়ন্ত্রণে নেয় ছাত্র ঐক্য এবং ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত হয় অভি-নীরু গ্রুপ। এদিন অভিসহ আরও পাঁচ জনকে বহিষ্কার করে ছাত্রদল। পরদিন ২৬ নভেম্বর আবারও এ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে ছাত্রদল থেকে বহিষ্কৃত অভি-নীরু গ্রুপ শহীদুল্লাহ হল ও ফজলুল হক হলে অবস্থান নিয়ে ছাত্র ঐক্যের নেতা কর্মীদের উপরে গুলি বর্ষণ করে। শুরু হয় ভয়াবহ বন্দুক যুদ্ধ। এসময়ক্যাম্পাসের চা দোকানদার নিমাই বুলেটবিদ্ধ হয়ে নিহত হন।
২৭ নভেম্বর, ১৯৯০ : এদিন সারা দেশে রাজপথ রেল পথ অবরোধ কর্মসূচী পালন করে ২২ দল। এদিকে টানা চতুর্থ দিনের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে বহিষ্কৃত অভি নীরু গ্রুপ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মধ্যে বন্দুক যুদ্ধ শুরু হয়। এসময় ঢাকা মেডিকেল থেকে রিক্সায় করে পিজি যাওয়ার পথে উভয় পক্ষের মাঝে পরে গুলিবিদ্ধ হন বিএমএ'র যুগ্ম মহাসচিব ডঃ শামসুল আলম খান মিলন।রিক্সায় তাঁর সাথে বসা ছিলেন আওয়ামীলীগ নেতা ডাঃ মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। ঐ রিক্সাতেই তাঁকে পিজিতে নেয়ার পথে মারা যান তিনি। এই হত্যাকাণ্ডই এরশাদের পতন ঘণ্টা বাজিয়ে দেয়।
লেখাটা অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে তাই আজ শুধুমাত্র সত্তর ও আশির দশকে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডগুলো তুলে ধরা হলো। লেখা শেষ পর্যন্ত পড়ে হয়তো আমার মতো আরও অনেকের মনে হতে পারে এখন শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ আগের তুলনায় অনেক ভালো। অন্তত লাশের মিছিলের দিক দিয়ে। পরের পর্বে সমাপ্ত।
(এ ছাড়া ১৯৭৭ সালে হনু ও গোপা নামে দুইজনের মৃত্যু হয়। তারিখ জানতে পারিনি। তাছাড়া সূত্র হিসেবে কোন পত্র পত্রিকার রেফারেন্সও দিতে পারছি না। এই দুই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে তথ্য সংগৃহীত হয়েছে ঐ সময়কার একজন জাতীয় ছাত্রলীগ নেতার কাছ থেকে। যেহেতু নির্দিষ্ট রেফারেন্স দিতে পারছি না তাই এই দুই হত্যাকাণ্ড মূল পোষ্টের সাথে এ্যাড করলাম না। হয়তো আমার জানাটা ভুলও হতে পারে। তেমন হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন সবাই এমনই প্রত্যাশা করছি। )
কৃতজ্ঞতা : আবু ই মনসুর, মিনহাজ ভূঁইয়া, জামিউল হাসান শোভন, তৌফিক।
তথ্য সূত্র : বিভিন্ন পত্র পত্রিকা, বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কাছে পাওয়া তথ্য এবং নিজের স্মৃতির খাতা থেকে।
শিক্ষাঙ্গনে কতিপয় ছাত্র সংগঠনের অব্যাহত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষ এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা বিতৃষ্ণা এসে গেছে ছাত্র রাজনীতির উপরে। কিছুদিন আগে বিশ্বজিতের উপরে ছাত্রলীগ নামধারীদের হামলার দৃশ্য আমরা টিভিতে দেখেছি, যা ছাত্র রাজনীতির স্বরূপ উন্মোচিত করেছে আবারও। শিক্ষাঙ্গন তথা ছাত্ররাজনীতির বর্তমান অবস্থা দেখে প্রশ্ন উঠেছে, যে ছাত্র ভাষার জন্য জীবন দিল, যে ছাত্র সমাজ দেশের স্বাধীনতার জন্য রক্তের নদীতে সাঁতার দিল, তারা আজ চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী হয়ে গেল কেন? এ প্রশ্নের জবাব জানার জন্য আমাদের গোঁড়ায় ফিরে যেতে হবে।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর ২৪ বছর শাসন শোষণের বিরুদ্ধে গর্জে উঠে বাংলার গন মানুষ। শুরু হয় জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম। সেই যুদ্ধে বিজয়ী হয়েই বাংলাদেশ নামক একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র পেয়েছি। যুদ্ধ শেষে বিজয়ীর বেশী মুক্তিযোদ্ধারা যখন ফিরে আসছিল তখন তাদের হাতে ছিল অস্ত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই কাঁধে স্টেনগান ঝুলিয়ে তার শিক্ষালয়ে যেত। শিক্ষাঙ্গনে যে শিক্ষকটি তার পড়ানোর দায়িত্বে ছিলেন, তিনি হয়তো মুক্তিযুদ্ধে যাননি; যুদ্ধের সময় চাকরি করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের আগুনে ঝলসানো তরুণ ছাত্রটি তার শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা রাখতে পারেননি, সেই শিক্ষক তাকে কী শিক্ষা দেবেন? কী পরীক্ষা নেবেন? এ সম্পর্কে রাজনৈতিক নেতৃত্বও কোনো দিকনির্দেশনা দেয়নি।
স্বাধীনতার পরপরই এজন্য শিক্ষাঙ্গনগুলোতে তখন অস্ত্রের ঝনঝনানি, রাজনীতিতে বিশেষ করে ছাত্ররাজনীতিতে ব্যাপক মতবিরোধ শুরু হয়েছে। সরকারি ছাত্র সংগঠনে ভাঙনের সানাই বাজে। ছাত্রলীগের দুই পক্ষ আলাদা আলাদাভাবে সম্মেলন করে, মারামারির মধ্য দিয়ে শেষ হয় সেই সম্মেলন। ছাত্রলীগের বৃহৎ অংশের নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে দেশের প্রথম বিরোধী রাজনৈতিক দল জাসদ। সেসময় শিক্ষাঙ্গনে জাসদ ছাত্রলীগ এবং মুজিববাদী ছাত্রলীগের মধ্যে মত বিরোধের জের ধরে অসংখ্য ছাত্র সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছিল। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে আরেকটি যুদ্ধাবস্থা তৈরি করে ফেলেছিল। ’৭৩-এ ডাকসু নির্বাচনে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ পরাজয় এড়াতে ব্যালট বাক্স হাইজ্যাক করেছিল। ছাত্ররাজনীতি তথা জাতীয় রাজনীতির ইতিহাসে ব্যালট বাক্স হাইজ্যাকের ঘটনা সেই প্রথম। ছাত্রদের নৈতিকতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য এর চাইতে বেশি ক্ষতিকর কাজ আর কী হতে পারে?
ছাত্ররাজনীতিকে নষ্ট করে দেওয়ার এই প্রক্রিয়া কিন্তু সেখানে থেমে যায়নি, তা অব্যাহত ছিল। ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যখন জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করেন তখন তিনিও একটি অনৈতিক পথে ছাত্রদের সংগঠন গড়ে তোলেন। এক বছর ক্ষমতা এবং প্রশাসনকে ব্যবহার করে ১৯৭৯ সালের ১ জানুয়ারি তিনি জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণা করেন। গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই জিয়াউর রহমানের এই প্রয়াসের সঙ্গে সবসময় ছিল। এনএসআই এর ডিজি সফদার ছাত্রদলের এই প্রথম কমিটিটি তৈরি করে জেনারেল জিয়াকে দেন। দেশ ও ছাত্রদের রাজনীতিতে সেই প্রথম গোয়েন্দা সংস্থা সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে শুরু করে। পার্থক্য বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়া উচিত নয় যে পাকিস্তানি সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিজয়ী ছাত্র সমাজ কীভাবে দেশীয় সামরিক গোয়েন্দাদের কাছে বন্দি হয়ে গেল।
জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর সাত্তারের হাত ঘুরে যখন বিএনপির শাসনের অবসান হল তখন জেনারেল এরশাদ এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। তিনিও জিয়াউর রহমানের কায়দায় "নতুন বাংলা ছাত্র সমাজ" গঠন করেন। ডাকসু তথা চলমান ছাত্র আন্দোলনের ভাঙন সৃষ্টির চেষ্টা করেন এবং এ কাজে জিয়াউর রহমানের মতো গোয়েন্দা সংস্থাকে সর্বোচ্চ ব্যবহার করেন। ডাকসুর এক নেতাকে দলে ভেড়ানোর জন্য ছাত্র উপদেষ্টা থেকে শুরু করে তাকে পূর্ণ মন্ত্রী পর্যন্ত বানিয়ে দেন। ৯ বছর সেই নেতা মন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি, পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন এরশাদ। কিন্তু এরশাদ সরকারের পতনের মুহূর্ত থেকে ভয়াবহ এক নৈরাজ্য দেখা দেয় ছাত্ররাজনীতির অঙ্গনে।
স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত আমরা যদি ছাত্ররাজনীতির ধারাবাহিক বিকাশকে পর্যালোচনা করি তবে দেখব ’৯০-এর আন্দোলনের পর থেকেই ছাত্র রাজনীতির অবক্ষয়ের অধ্যায় শুরু বললেও সম্ভবত ভুল করা হবে না। খুনোখুনি একটা ‘ফ্রি ফর অল’-এ পরিণত হয় এসময়েই। আশির দশকেও এই অবস্থা ছিল। পাশাপাশি ছিল মেধা ভিত্তিক ছাত্র রাজনীতির চর্চাও। সেই জন্যই দীর্ঘ নয় বছর স্বৈর শাসক এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন নব্বই সালে গণ অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। পতন হয় এরশাদের। এরশাদ পতনের পরে আমরা ভেবেছিলাম অবস্থার উন্নতি হবে। সন্ত্রাস এবং সন্ত্রাসী মুক্ত হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখলাম পতিত স্বৈরাচার এরশাদের অপশাসনকে যারা সহযোগিতা করে এসেছে তারাই আশ্রয় পেয়ে গেলো দুই প্রধান দলে। বিশেষ করে একটি ঘটনার প্রতি আমি বিশেষভাবে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করব। ’৯০ দশকের শুরুতে গোলাম ফারুক অভির ছাত্রলীগে যোগদানের ব্যাপারটি বিস্মিত করে সবাইকে। কারণ, অভি ছিল ছাত্রদলের শক্তিশালী মাসল; যারা বিভিন্ন সময় ছাত্রলীগের ওপর সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছিল। সেই অভি হঠাত্ করে ছাত্রলীগে যোগ দিল কেন? ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক প্রশ্ন দেখা দেয়। আজ পর্যন্ত যার কোনো সদুত্তর মেলেনি। আওয়ামী লীগের কর্তৃপক্ষ মহল থেকে বলা হয়, অভির পুরো পরিবার তো আওয়ামী পরিবার। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে, তাতে কী হয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষের এই জবাবে সন্তুষ্ট হয় না কেউই। বিশেষ করে সংগ্রামী ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা, যার পরিণতিতে ছাত্র ঐক্য ভেঙে যায়। ছাত্রলীগের ব্যানারে অভি গ্রুপ আগের মতোই সক্রিয় থাকে। এবং ১৯৯১ সালের অক্টোবরে ছাত্রলীগের ব্যানারে অভি গ্রুপ ও ছাত্রদলের মধ্যে বন্দুক যুদ্ধে মারা যায় ছাত্রদলের মীর্জা গালিব, লিটনসহ চার জন। সেই ঘটনার পরে কয়েকজন সহযোগী অভি ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত জগন্নাথ হলের গেস্ট রুম থেকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার হন।
"সন্ত্রাস নির্ভর ছাত্র রাজনীতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশের মিছিল - ০১" শিরোনামে পূর্ববর্তী পোস্টে আমরা সত্তর ও আশির দশকে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডগুলো তুলে ধরেছিলাম। আসুন এবার দেখা যাক নব্বই এবং এই শতাব্দীর প্রথম দশকে ক্যাম্পাসে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডগুলো -
২০ জুন, ১৯৯১ : নব্বই এর গণ অভ্যুত্থানের পরে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার পরে ক্যাম্পাসে প্রথম নিহত হন মাহবুব। ২০ জুন সিট দখলসহ নিজেদের মধ্যে বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষের সূত্র ধরে আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্রলীগ এবং জাসদ ছাত্রলীগের কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সময় তা মধুর ক্যান্টিন থেকে সব হলে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। জাসদ ছাত্রলীগের কর্মীরা মুহসীন হলে এবং আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্রলীগ জহুরুল হক হল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাবে অবস্থান নিয়ে বন্দুক যুদ্ধে লিপ্ত হয়। সংঘর্ষ চলাকালে আইইআর ভবনের পশ্চিম গেটের সামনে জাসদ ছাত্রলীগের নেতা মুহসীন হল ছাত্রলীগের সভাপতি ও নব্বইয়ের গণ অভ্যুত্থানের বীর সৈনিক মাহবুবুর রহমান গুলিবিদ্ধ হন। রক্তাক্ত অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে গেলে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মাহবুব ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের এমএ শেষ পর্ব এবং মুহসীন হলের ৩২৪ নম্বর কক্ষের আবাসিক ছাত্র ছিলেন।
মাত্র ৬/৭ মাস আগে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের শেষ সময়ে যখন ডাঃ মিলন গুলিবিদ্ধ হন তখন কয়েকজন তরুণ তাকে রিক্সায় পিজি হাসপাতালে নেয়ার সময়েই রিক্সায় মারা যান ডঃ মিলন। সেদিন ঐ রিক্সায় মাহবুব ছিলেন এবং তাঁর কোলেই মৃত্যু হয় শহীদ মিলনের। ছয় মাস পরে তাঁকেও একই ভাগ্য বরুণ করতে হয়।
২৭ অক্টোবর, ১৯৯১ : দীর্ঘ ৪ মাস ধরে ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ কর্মীদের মধ্যে বিভিন্ন সন্ত্রাসী ঘটনার জের ধরে ছাত্রদল জিএস ডাকসুতে বৈঠক শেষে একটি মিছিল বের করে। মিছিলটি লেকচার থিয়েটারে পৌঁছলে সূর্য সেন হল থেকে আসা ছাত্রলীগের আরো একটি মিছিলের মুখোমুখি হয়। এসময় উভয়ের মধ্যে গোলাগুলি শুরু হয়। ঘন্টাব্যপী এই বন্দুক যুদ্ধে ভাষা ইন্সটিটিউটের সামনে ছাত্রদল কর্মী মির্জা গালিব গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। গালিবের মৃতদেহ সেখানেই পরে থাকলে এগিয়ে যায় ছাত্রদল কর্মীরা, এতে ছাত্রদল কর্মী লিটন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। এই দুই জনের মৃত্যুর পরে বেপরোয়া হয়ে ওঠে ছাত্রদল এবং ছাত্রলীগের ওপর ব্যাপকভাবে গুলিবর্ষণ করলে রেজিস্টারের বাসভবনের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন ছাত্রলীগ কর্মী মিজানুর রহমান ও এক টোকাই। ভয়াবহ এই সংঘর্ষে কয়েক শত রাউন্ড গুলি বিনিময় হয় উভয় পক্ষের মধ্যে। সেদিনের সংঘর্ষের ভয়াবহতা এমনই ছিল যে ক্যাম্পাসে কারফিউ জারি করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়।
৯ জানুয়ারি, ১৯৯২ : ৯২ সালের ০৯ জানুয়ারী ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন নিয়ে সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে শামসুন্নাহার হলের সামনে প্রতিপক্ষের গুলিতে প্রাণ হারান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও নব্বই এর গণ অভ্যুত্থানের অন্যতম সেনাপতি ছাত্রনেতা মনিরুজ্জামান বাদল ঢাবির উল্লেখ্য, ঐ সময় ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর আলোচনা সভা চলছিল টিএসসিতে। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
১৩ মার্চ, ১৯৯২ : ১৯৯২ সালের ১৩ মার্চ বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে বন্দুক যুদ্ধে লিপ্ত হয় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও আওয়ামীলীগ সমর্থিত ছাত্রলীগ (ম-ই) এর অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা। এই সন্ত্রাসের প্রতিবাদে তাত্ক্ষণিকভাবে সন্ত্রাসের প্রতিবাদে টিএসসি এলাকায় একটা সন্ত্রাস বিরোধী মিছিল বের করে গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্য। গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্যের সন্ত্রাস এবং সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সেই মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্য মঈন হোসেন রাজু। সন্ত্রাস বিরোধী শ্লোগানে শ্লোগানে যখন প্রকম্পিত টিএসসি এলাকা ঠিক সেই সময় লাইব্রেরী এলাকায় অবস্থান নেয়া ছাত্রদলের সন্ত্রাসীরা মিছিলে গুলি বর্ষণ করলে টিএসসি সড়ক দ্বীপে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ও শহীদুল্লাহ হলের ১২০ নম্বর কক্ষের ছাত্র মঈন হোসেন রাজু। বিনা কারণে এই গুলি বর্ষণের ঘটনা ঘটে। ছাত্রদল এই হত্যার দায় অস্বীকার করলেও সেদিনের ঐ গুলি বর্ষণের সাথে পরবর্তীকালীণ ছাত্রদল সভাপতি হাবিবুন্নবী সোহেলের সংশ্লিষ্টতার কথা শোনা যায়। শহীদ মঈন হোসেন রাজু ৯০’র স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে অন্যতম সৈনিক ছিলেন। ছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন ঢাবি শাখার সদস্য।
রাজুসহ সন্ত্রাস বিরোধী আন্দোলনের সকল শহীদের স্মরণে নির্মিত সন্ত্রাস বিরোধী রাজু ভাস্কর্য ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এ কে আজাদ চৌধুরী উদ্বোধন করেন। এই ভাস্কর্য নির্মাণে জড়িত শিল্পীরা হলেন ভাস্বর শ্যামল চৌধুরী ও তার সহযোগী গোপাল পাল।
৩০ আগস্ট, ১৯৯২ : এদিন ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের বিবদমান দুই গ্রুপের মধ্যে ভয়াবহ গোলাগুলিতে অজ্ঞাত পরিচয় এক যুবক নিহত হন। ছাত্রদলের একটি গ্রুপের পক্ষ থেকে তাকে ক্যাম্পাসে আনা হয়েছিল বলে জানা যায়। (সুত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক - ৩১ আগস্ট ও ০৫ সেপ্টেম্বর ১৯৯২।)
৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৯২ : সূর্যসেন হল দখলকে কেন্দ্র করে ছাত্রদলের দুটি গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে দুজন ছাত্র নিহত হয়। গ্রুপ দুটি হচ্ছে সূর্যসেন হল ও মুহসীন হল ভিত্তিক রতন গ্রুপ এবং অন্যটি মুজিব ও জসীম উদ্দিন হল ভিত্তিক ইলিয়াস গ্রুপ। মুজিব ও জসীম উদ্দিন হল ভিত্তিক গ্রুপটি সূর্যসেন হল দখল করার সময় ভূগোল বিভাগের অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র জিয়া হল শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক আশরাফুল আজম মামুনকে ২৬৫ নম্বর কক্ষে গুলি করে হত্যা করা হয়। হত্যা করে তার লাশ একটা পরিত্যক্ত পানির ট্যাংকে গুম করা হয়। নিহত মামুন ছিলেন জাতীয় দাবায় রানার্স আপ ও মার্শাল আর্টে ব্ল্যাক বেল্ট। মেধাবী ছাত্র মামুন ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ থেকে ডাবল স্ট্যান্ড করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তার মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা পর মুজিব হলের দেয়াল টপকানোর সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ইতিহাস বিভাগের ছাত্র মাহমুদ হোসেন।
ভয়াবহ এই বন্দুক যুদ্ধে চারশো রাউন্ড গুলি বিনিময় হয়। পরিস্থিতি এতোটাই মারাত্মক ছিল যে তা নিয়ন্ত্রণে ক্যাম্পাসে বিডিআর মোতায়েন করতে হয়। কথিত আছে সূর্যসেন হলের এক সময়ের ক্যান্টিন বয় এবং পরবর্তীতে শীর্ষ সন্ত্রাসী বনে যাওয়া সুব্রত বাইন এবং পরবর্তী সময়ে মন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর এই সংঘর্ষের সময় সূর্য সেন হল গেট পাহারায় ছিলেন। কিন্তু বেইমানি করে বড় অংকের অর্থের বিনিময়ে হল গেটের চাবি প্রতিপক্ষ ইলিয়াস গ্রুপকে দিয়ে দেয়। আর এজন্যই বিনা বাঁধায় সূর্য সেন হল দখলে নিতে পারে ইলিয়াস গ্রুপ। মামুনকে নিজ হাতে পিস্তল দিয়ে গুলি করে হত্যা করে ছিলেন ইলিয়াস আলী যা সেসময়ের পত্র পত্রিকায় ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছিল।
ঘটনার পর পরই ভিসি ডঃ মনিরুজ্জামান মিঞার সভাপতিত্বে সিন্ডিকেট সভায় ঘটনাবলী নিয়ে আলোচনা এবং যথাযথ তদন্তের দাবি করা হয়। সেই সাথে দুই দিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্রদলের এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে সারা দেশে নিন্দার ঝড় ওঠে। সকলে ধিক্কার জানাতে থাকে ছাত্রদল সন্ত্রাসীদের। দলীয় কোন্দলের জের ধরে ছাত্রদলের দুই নেতা নিহত হওয়ার ঘটনায় বিএনপির পক্ষ থেকে ছাত্রদলের সকল কর্মকাণ্ড সাময়িকভাবে স্থগিত ঘোষণা করা হয়। উল্লেখ্য, এর মাত্র ৩ মাস আগে সাবেক রাকসু ভিপি রুহুল কবীর আহমেদ রিজভীকে সভাপতি এবং ইলিয়াস আলীকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রদলের নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছিল। শুধু তাই নয় বিএনপি ক্ষমতায় থাকা স্বত্বেও মামুন ও মাহমুদ হত্যা মামলায় গ্রেফতার হন ইলিয়াস আলী।
১ নভেম্বর, ১৯৯৩ : ঠিকাদারের কাছ থেকে চাঁদা আদায় ও ভাগবাটোয়ারাকে কেন্দ্র করে প্রশাসনিক ভবনে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির নাট্য সম্পাদক আলী জিন্নাহকে গুলিতে হত্যা করে প্রতিপক্ষ গ্রুপের ছাত্রদলের সন্ত্রাসীরা।
২২ নভেম্বর, ১৯৯৩ : টেন্ডারের ভাগবাটোয়ারাকে কেন্দ্র করে মূল ছাত্রলীগ ও প্রভাবশালী যুবলীগ নেতা মোস্তফা মহসিন মন্টু গ্রুপের মধ্যে কোন্দলের জের ধরে ২২ নভেম্বর গুলি করে হত্যা করা হয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছাত্রলীগ নেতা অলোক কান্তিকে। তিনি ছাত্রলীগের মোস্তফা মহসীন মন্টু গ্রুপের নেতা ছিলেন। এই ঘটনার পরে যুবলীগের পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় মন্টুকে। পরবর্তীতে মন্টু ডঃ কামাল হোসেনের দল গণফোরামে যোগ দিয়ে রাজনীতি থেকে এক প্রকার হারিয়েই যান।
১ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৪ : ডাসের অভ্যন্তরে একটি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের পরস্পরবিরোধী দুটি গ্রুপের গোলাগুলি শুরু হয়। এ সময় পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। একটি শেল তথ্য ও গ্রন্থাগার বিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র কামরুল ইসলাম বুলবুলের বুকে লাগলে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এ হতাকান্ডের জন্য ছাত্রলীগ (বা-কা) সভাপতি ছাত্রনেতা রুহুল কুদ্দুস বাবু প্রতিপক্ষ গ্রুপের ১৪ জনকে আসামি করে রমনা থানায় মামলা করেন।
২ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৪ : ছাত্রদলের বিবদমান দুই গ্রুপের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ডেমোগ্রাফি বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র সরোয়ার হোসেন মিঠু। একই মাসে
২২ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৬ : ১৯৯৬ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে স্যার সলিমুল্লাহ হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্স শেষ বর্ষের ছাত্র জাকিরকে গুলি করে হত্যা করা হয় জগন্নাথ হলের গোবিন্দচন্দ্র দেব ভবনের ৭১ নম্বর কক্ষে।
১৩ মার্চ , ১৯৯৭ : ১৩ মার্চ ছাত্রদলের প্রভাবশালী নেতা কামরুজ্জামান রতন নিয়ন্ত্রিত গ্রুপ ও বরিশাল টিটো গ্রুপের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে মুজিব হলের ৩০৫ নং কক্ষে গুলিতে মারা যান আরিফ হোসেন তাজ। তিনি ছিলেন অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্র।
১১ জুলাই, ১৯৯৭ : ১৯৯৭ সালের ১১ জুলাই কার্জন হল এলাকায় খুন হন ছাত্রলীগের কর্মী তনাই। অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণেই এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। একই বছর শাহীন নামে এক ছাত্রের মৃতদেহ পাওয়া যায় কার্জন হলে।
২৩ এপ্রিল, ১৯৯৮ : ১৯৯৮ সালের ২৩ এপ্রিল সূর্য সেন হল দখলকে কেন্দ্র করে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সাংবাদিকতা বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র ছাত্রলীগ নেতা পার্থ প্রতিম আচার্য।
২৯ মার্চ, ২০০১ : ৫৬ ভরি স্বর্ণ ছিনতাই ও টাকা ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে জহুরুল হক হলের পুকুরের পাশে গুলিতে নিহত হন খায়রুল আলম লিটন। নিহত লিটন 'কুত্তা লিটন' নামে পরিচিত ছিলেন।
১৭ আগস্ট, ২০০১ : অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান জিয়াউর রহমান হলের ছাত্রলীগ নেতা ফিরোজ আহমেদ। ফিরোজ ছিলেন ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র এবং থাকতেন জিয়া হলের ৪২০ নম্বর কক্ষে।
১৫ সেপ্টেম্বর, ২০০৪ : ২০০৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিহত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হল ছাত্রদলের নেতা মাহবুবুল ইসলাম খোকন। ওই হত্যাকাণ্ডের পর দুটি তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও প্রতিবেদন জমা পড়েনি। শাহবাগ থানায় মামলা হলেও এর বিচারকার্য শেষ হয়নি।
১/৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১০ : সর্বশেষ ছাত্র হত্যার ঘটনা ঘটে ২০১০ সালের ১ ৩ ফেব্রুয়ারি এ দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলের আবাসিক ছাত্র ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের তখনকার তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবু বকর সিদ্দিক নিহত হন। এর আগে ১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগের তখনকার হল শাখার সভাপতি সাইদুজ্জামান ফারুক ও সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান মোল্লা গ্রুপের সংঘর্ষের সময় তিনি আহত হন। মৃত্যুর দু' মাস পর ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃত বিভাগের শিক্ষার্থী আবু বকরের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের সমাপনী পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। তাতে প্রথম হয়েছিলেন তিনি।
এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে একাধিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে ঢাবি ক্যাম্পাসে যার প্রকৃত তথ্য পাওয়া যায় না। সব মিলিয়ে দেখা যায় স্বাধীনতার পর থেকে দুই ছাত্র সংগঠনের মধ্যে বন্দুক যুদ্ধ, অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের এবং প্রতিপক্ষের হাতে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে প্রায় ৬০টি। দেশের সর্ব শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠে প্রাণ প্রদীপ নিভে যায় ষাট জনের। প্রথম পর্ব থেকে লক্ষ্য করে দেখুন দশক হিসেবে, দেখা যাচ্ছে আশি ও নব্বই এর দশকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে সবচেয়ে বেশী। পক্ষান্তরে গত দশকে মৃত্যু হয় চারজনের। গত দশকে ছাত্র সংঘর্ষের জের ধরে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘটনাও খুব বেশী ঘটেনি। আগের মতো মারাত্মক সংঘর্ষের ঘটনা খুব কম ঘটেছে। এই দিক বিবেচনা করেই লেখার শুরুতে বলেছিলাম বর্তমানে দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে পূর্বের যে কোন সময়ের তুলনায় ভালো পরিবেশ বিরাজ করছে। আবারও বলছি এটা আমার একান্ত নিজস্ব ভাবনা।
(বিঃ দ্রঃ : গত পর্বে দুইটি হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারিনি বলে মূল লেখায় যোগ করিনি। কিন্তু পরে জানতে পারি ডাকসু সংগ্রহশালা থেকে। ডাকসু সংগ্রহশালার তথ্য অনুযায়ী ১৯৭৭ সালে ক্যাম্পাসে আওরঙ্গ ও লুকু নামে দুটি গ্রুপ ছিল। ওই বছর লুকু গ্রুপের ইনু ও গোগা নামে দুই অনুসারীকে আওরঙ্গ গ্রুপের সমর্থকরা হত্যা করে। সে বছরেই আওরঙ্গের ভাই রুন্টু নিহত হয়। ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ দুপুরে মুহসিন হলের ৪২৬ নং কক্ষে বোমা বিস্ফোরণে ছাত্রদলের বাবলুসহ মইনউদ্দিন, নূর মোহাম্মদ মারা যায়।)
তথ্য সূত্র : বিভিন্ন পত্র পত্রিকা, সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্র নেতৃবৃন্দ, নিহত ছাত্রদল নেতা মামুনের পরিবার ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কাছে পাওয়া তথ্য এবং নিজের স্মৃতির পাতা থেকে।
No comments:
Post a Comment