Wednesday, February 19, 2014

বাকৃবিতে ছাত্রলীগের গুলিতে শিশু নিহত, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ গণরোষ, ছাত্রাবাসে আগুন ৫০ কক্ষ ভাংচুর

সূত্রঃ ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের মধ্যে গতকাল ব্যাপক সংঘর্ষ ও গোলাগুলি হয়েছে। ছাত্রলীগের দুই পক্ষের গোলাগুলির মধ্যে ‘ক্রসফায়ারে’ ১০ বছরের একটি শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনার পর বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলে, হামলা চালায় লাঠিসোটা নিয়ে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাকৃবি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বিলুপ্ত করা হয়েছে ছাত্রলীগের বাকৃবি শাখা কমিটি।১

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের বিরোধের জেরে বাকৃবি ক্যাম্পাসে গতকাল ছাত্রলীগের সভাপতি ও সম্পাদক গ্রুপের মধ্যে টানা চতুর্থ দিনের মতো সংঘর্ষ ও ব্যাপক গোলাগুলি হয়। গুলিবৃষ্টির মাঝে পড়ে লন্ডন ব্রিজ এলাকায় মারা যায় রাব্বি নামের ১০ বছরের একটি শিশু।


মুহূর্তের মধ্যে এ খবর ছড়িয়ে পড়লে ক্যাম্পাসের আশপাশ এলাকার বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী ছাত্রলীগকে প্রতিহত করতে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তারা লাঠিসোটাসহ বিভিন্ন ধরনের দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালান। তবে এর আগেই ছাত্রলীগ ক্যাডাররা ক্যাম্পাস থেকে পালিয়ে যান।
এ অবস্থায় এলাকাবাসীর রোষানলে পড়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা।


এলাকাবাসীর রোষানল থেকে বাঁচতে শিক্ষার্থীদের যে, যে দিকে পেড়েছে পালিয়েছে। একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪টি হলে আগ্নিসংযোগ ও ব্যাপক ভাংচুর করেন। আগুনে শহীদ জামাল হোসেন হল ও ঈশা খাঁ হলের অন্তত ৫০টি কক্ষ ভস্মীভূত হয়। ঘটনার পর অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ঘটনার পর গ্রেফতার করা হয়েছে ৪ ছাত্রলীগ ক্যাডারকে। তবে তাদের পরিচয় পাওয়া যায়নি।

গতকালের আগে টানা তিনদিন আধিপত্য, নিয়োগ ও টেন্ডারবাণিজ্য নিয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের মাঝে দফায় দফায় সংঘর্ষ হলেও ছাত্রলীগ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিংবা সরকারের টনক নড়েনি। এর জেরে গতকাল ফের ওই দুই গ্রুপের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ ও গোলাগুলি হয়। এ সময় উভয়পক্ষের ক্রসফায়ারে শিশু রাব্বি নিহত হয়।
এ খবর ছড়িয়ে পড়লে দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রলীগের তাণ্ডবে অতিষ্ঠ এলাকাবাসীর ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে। এলাকাবাসী ছাত্রলীগ প্রতিহত করতে ক্যাম্পাসে হামলা চালায়। ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষ ও এলাকাবাসীর হামলা চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয়সহ আশপাশের এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এ সময় এলাকাবাসী, ছাত্রলীগ নেতাকর্মী ও সাধারণ শিক্ষার্থীসহ অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন।
গুলিবিদ্ধ হয়েছেন ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক শাহিন মাহমুদ এবং শহীদ জামাল হোসেন হলের সাংগঠনিক সম্পাদক জয় বণিক। দুই ঘণ্টা ধরে ছাত্রলীগের সংঘর্ষ, অস্ত্র নিয়ে মহড়া, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, গোলাগুলি এবং হলে গ্রামবাসীর ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ চললেও গতকালও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং পুলিশকে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে। ঘটনার সময় পুলিশকে কয়েক রাউন্ড গুলি করতে দেখা গেলেও অন্য কোনো অ্যাকশনে তাদের দেখা যায়নি।
প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জানান, সংঘর্ষের সময় সভাপতি গ্রুপের আবু রায়হান, আনোয়ার পারভেজ রিপন, সাজ্জাদ এবং সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের শাহীন মাহমুদ ও আসাদুজ্জামান প্রকাশ্যে একে অপরকে লক্ষ্য করে গুলি করেছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে আধিপত্য বিস্তার, পূর্ব শত্রুতা, নিয়োগ ও টেন্ডারবাণিজ্য নিয়ে বাকৃবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি শামসুদ্দিন আল আজাদ এবং সাধারণ সম্পাদক রফিকুজ্জামান ইমন দু’গ্রুপের মধ্যে বিরোধ চলছিল।
এ নিয়ে গতকালের আগে টানা ৩ দিন দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। তিনদিনের সংঘর্ষের জেরে গতকাল দুপুর ১২টার দিকে ক্যাম্পাসের জব্বার মোড় থেকে লন্ডন ব্রিজ এলাকাজুড়ে ফের সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ওই দু’গ্রুপ।
এ সময় পুলিশ ও প্রশাসনের সামনে ব্যাপক গোলাগুলি, দফায়-দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
সংঘর্ষের একপর্যায়ে ক্যাম্পাসের লন্ডন ব্রিজ এলাকায় গরু চড়াতে গিয়ে দুইপক্ষের গুলিবৃষ্টির মাঝে পড়ে ১০ বছরের মাদরাসাছাত্র শিশু রাব্বি। মাথায় গুলি লেগে গুরুতর আহত হয় সে। তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ভর্তির দুই ঘণ্টা পর তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিত্সক।
নিহত শিশু রাব্বি ক্যাম্পাসের পার্শ্ববর্তী বড়য়া এলাকার টেম্পো চালক দুলালের ছেলে। তার মৃত্যুর খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে উত্তেজনায় ফেটে পড়েন এলাকাবাসী। লাঠিসোটা ও দা-বঁটি নিয়ে বিক্ষব্ধ জনতা ছাত্রলীগকে প্রতিহত করতে মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাসে ছুটে যান।
তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ মোড় ও ফসিলের মোড়ের গেট দিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন। তবে এর আগেই ক্যাম্পাস ছেড়ে পালিয়ে বেঁচে যান ছাত্রলীগ ক্যাডাররা। এ অবস্থায় বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসীর হামলার শিকার হন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
তবে ঠিক কতজন শিক্ষার্থী এলাকাবাসীর হামলায় আহত হয়েছেন তা জানা যায়নি। হামলার একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঈশা খাঁ হল, শহীদ জামাল হোসেন হল, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হল এবং শহীদ শামসুল হক হলে ব্যাপক ভাংচুর, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগ করেন।
আগুনে শহীদ জামাল হোসেন হল এবং ঈশা খাঁ হলের সম্প্রসারিত টিনসেডের প্রায় ৫০টি কক্ষের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও মূল্যবান কাগজপত্র ভস্মীভূত হয়। পরে বিকাল ৫টার দিকে ময়মনসিংহ ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রেণে আনে।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি সামাল দিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় ক্যাম্পাস। বন্ধ ঘোষণার পর গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার মধ্যে সব ছাত্র এবং আজ সকাল ৮টার মধ্যে ছাত্রীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
ঘটনার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ও এর আশপাশের এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আতঙ্কে লোকজন ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। কয়েকটি এলাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর এলাকাবাসীর হামলার ঘটনা ঘটেছে। হামলা থেকে বাঁচতে বাকৃবির শিক্ষার্থী পরিচয় আড়াল করতেও দেখা গেছে অনেককে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হল ছাড়ার ঘোষণা দেয়ার পর থেকে ঘরমুখী শিক্ষার্থীদের চোখে মুখে দেখা গেছে ব্যাপক আতঙ্ক।
ঘটনার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর ড. নাসরিন সুলতানা জোয়েনা জানান, তুচ্ছ ঘটনায় গত তিনদিন ধরে দু’গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। গুলিবিদ্ধ শিশু মারা যাওয়ার পর এলাকাবাসী হামলা চালায়। কয়েক দিক থেকে হামলা হওয়ায় ঠেকানো যায়নি।
বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পুলিশ দুই শিক্ষার্থীকে আটক করেছে। তবে পুলিশ সূত্রে রাতে জানা গেছে, সংঘর্ষের ঘটনায় ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার অন্তত ৪ ক্যাডারকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উত্তর) আবু আহমদ আল মামুন জানিয়েছেন, সংঘর্ষ চলাকালে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বেশ কয়েক রাউন্ড টিয়ারশেল নিক্ষেপ করেছে পুলিশ। ক্যাম্পাসে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির কারণে শাখা ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ কমিটি। গতকাল বিকাল ৪টার দিকে মোবাইল বার্তায় কমিটি বিলুপ্তের সত্যতা স্বীকার করেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ।
সেইসঙ্গে কমিটির সভাপতির দায়িত্বে থাকা শামসুদ্দিন আল আজাদ এবং সাধারণ সম্পাদক রফিকুজ্জামান ইমনকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
শোকে স্তব্ধ রাব্বির মা-বাবা : গোলাগুলির শব্দ শুনে গতকাল দুপুরে বাড়ি থেকে বের হয় ১০ বছর বয়সী শিশু রাব্বী। সে তার দাদিকে নিরাপদে নিয়ে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু ছাত্রলীগের ক্রসফায়ার তার জীবনটাকেই কেড়ে নিল।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জব্বার মোড় এলাকায় তার দাদি গরু চরাচ্ছিলেন। সে দাদিকে ডেকে আনতে গিয়ে জব্বারের মোড় এলাকায় ছাত্রলীগের বন্দুকযুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়। পরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় গতকাল বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে সে মারা যায়। রাব্বি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বয়রা এলাকার দরিদ্র দুলাল মিয়া ও মুনিরা বেগমের একমাত্র ছেলে।
গতকাল বিকালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে রাব্বির লাশের পাশে বসে বিলাপ করছিলেন মা মুনিরা বেগম। একমাত্র শিশুপুত্রকে হারিয়ে নির্বাক বাবা ডুকরে কাঁদছেন। বুকের মানিককে হারিয়ে শোকে স্তব্ধ রাব্বির মা-বাবা। সদর উপজেলার বয়রা এলাকাতেও এ অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুশোক সবাইকে স্পর্শ করেছে গভীর বেদনায়।
রাব্বির মা-বাবা দু’জনেই এ হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করে বলেছেন,“ওরা আমার বুকের মানিককে কেড়ে নিল। ওর তো কোনো অপরাধ ছিল না। কেন ওরা আমার পোলাডারে গুলি করে মারল? আমরা এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।”
এ হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে এখনও কোতোয়ালি মডেল থানায় কোনো মামলা হয়নি। গতকাল সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে এ বিষয়ে ময়মনসিংহ জেলা পুলিশ সুপার মো. গোলাম কিবরিয়া বাংলানিউজকে জানান, রাব্বির মা-বাবা এখনও কোনো মামলা করেনি। মামলা হলে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ইবি ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত : সংগঠনবিরোধী কর্মকাণ্ডে অংশ গ্রহণের দায়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। বুধবার সংঘর্ষের সময় পুলিশের শটগান নিয়ে ছাত্রদল নেতাকর্মীদের গুলি করে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের এক নেতা। এ ঘটনায় সমালোচনার ঝড় ওঠে দেশজুড়ে।

সুত্র বিডিটুডে নিউজ 

No comments:

Post a Comment