বেলাল হোসাইন রাহাত
» |
শিক্ষক রাজনীতি, ছাত্র হত্যা, নিয়মবহির্ভূত শিক্ষক নিয়োগ ও ছাত্রলীগের তাণ্ডবে গতবছর (২০১২) অধিকাংশ সময় উত্তাল ছিল দেশের একমাত্র আবাসিক ক্যাম্পাস জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। সাবেক ভিসি ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড মনে নেয়নি সাধারণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানায় সাধারণ শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা। বাধ্য হয়ে গতবছর মে মাসে বিদায় নিতে হয় তত্কালীন দুই শতাধিক শিক্ষক নিয়োগ দেয়া ভিসি অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবিরকে। তারপর ১৭ মে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে। বাইরে থেকে ভিসি নিয়োগের পর শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা দিলেও উপাচার্য সুষ্ঠুভাবে ক্যাম্পাস কিছুদিন পরিচালনা করেন। কিছুদিন পর শিক্ষকরা সিনেট, সিন্ডিকেট ও ডিন নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। কিন্তু উপাচার্য আনোয়ার হোসেন আন্দোলনকারীদের পাশকাটিয়ে ভিসি প্যানেল নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। এতে আবারও উত্তাল হয়ে ওঠে ক্যাম্পাস। পুলিশ পাহারায় প্যানেল নির্বাচন সম্পন্ন করেন উপাচার্য। আন্দোলনরত শিক্ষকরা নির্বাচন বয়কট করে ওই দিনকে কালো দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।
ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ : তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত বছর ২ আগস্ট ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের একনেতাকে কুপিয়ে আহত করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এসময় পুলিশ এক ছাত্রলীগ কর্মীকে আটক করলে শুরু হয় সংঘর্ষ। একপর্যায়ে পাঁচ শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হলে শুরু হয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ। গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় ছাত্রলীগের নেতৃত্বে শিক্ষার্থীরা রামদা, রড ও লাঠিসহ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ১৬ ঘণ্টা অবরোধ করে ক্যাম্পাসে ব্যাপক ভাংচুর করে। পরের দিন সিণ্ডিকেটের এক জরুরি সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ঈদের ছুটি ৯ আগস্ট থেকে এগিয়ে এনে ২ আগস্ট নির্ধারণ করে ক্যাম্পাস ছুটি ঘোষণা করা হয়। এ ঘটনায় উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মো. ফরহাদ হোসেনকে প্রধান করে ছয় সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ২১ কর্মদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়। কিন্তু গত ছয় মাসেও তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি। পরে উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন এ ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে শিবিরের ওপর দোষ চাপিয়ে ক্ষান্ত হন।
প্রক্টরের সামনে ছাত্রলীগের সশস্ত্র অবস্থান : গত ১৩ অক্টোবর ভর্তি পরীক্ষার সময় ছাত্রলীগের দুই গু্রপের মধ্যে অর্থাত্ শহীদ রফিক-জব্বার ও মওলানা ভাসানী হলের নেতাকর্মীরা সশস্ত্র অবস্থায় মহড়া দেয়। রড, লাঠি, হকিস্টিক, হাতুড়ি, পাইপ নিয়ে তারা প্রক্টরিয়াল বডির সদস্য ও হল প্রভোস্টের সামনে শোডাউন দিতে থাকে। একপর্যায়ে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হলে ছাত্রলীগের ৪ নেতাকর্মী আহত হয়। সে সময় প্রক্টর ও শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক আরজু মিয়া ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে হলে ফিরে যাবার জন্য অনুরোধ জানায়। প্রক্টরের কথামতো দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তারা হলে ফিরে যান।
ছাত্রদলের মিছিলে ছাত্রলীগের হামলা : ২০১২-২০১৩ শিক্ষাবর্ষের প্রথমবর্ষ স্নাতক (সম্মান) শ্রেণীর ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ছাত্রদল সভাপতি ও সেক্রেটারির নেতৃত্বে মিছিল বের করলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের ব্যানার কেড়ে নেয়। এসময় ২০-২৫ জন ছাত্রলীগ ক্যাডার রড, পাইপ, হাতুড়ি আর লাঠি নিয়ে ছাত্রদল নেতাকর্মীদের ধাওয়া করে। ধাওয়া খেয়ে ক্যাম্পাস থেকে পালিয়ে যায় ছাত্রদল।
ফের ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে সংঘর্ষ : চলতি মাসেই এক ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করার জের ধরে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে প্রক্টরসহ ৮ ছাত্রলীগ কর্মী আহত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আ ফ ম কামাল উদ্দিন হলের ছাত্রলীগ কর্মীরা রামদা, চাপাতি, রড, লাঠি, হাতুড়ি ও ইটপাটকেলের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ছাত্রলীগের কর্মীরা ক্যাম্পাসের কয়েকটি দোকান ভাংচুর করে।
ভিসির পদত্যাগ দাবি : সম্প্রতি শিক্ষকদের নিরাপত্তা প্রদানে ব্যর্থতা ও মিডিয়ার সামনে শিক্ষার্থীদের নিয়ে নির্লজ্জ মিথ্যাচারের প্রতিবাদে শিক্ষক সমিতির টানা ৭ দিন কর্মবিরতিতে অচল হয়ে পড়ে ক্যাম্পাস। এ ঘটনায় ভিসি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন পদত্যাগ নাটক মঞ্চস্থ করায় শিক্ষকরা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। আবদুল মালেক নামে এক শিক্ষার্থী অসুস্থ হলে সময় মতো অ্যাম্বুলেন্স না পেয়ে সাবেক ভিসি অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবিরপন্থী ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নেতৃত্বে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ব্যাপক ভাংচুর ও ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে। এ সময় আবাসিক শিক্ষকদের বাসায়ও তারা ব্যাপক ভাংচুর চালায়।
পরে ছাত্রলীগের আরেক অংশের নেতাকর্মীরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের মারধর শুরু করলে তারা অবরোধ ছেড়ে দেয়। এ ঘটনায় ভিসি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন ও প্রক্টর ড. সোহলে আহমেদ শিক্ষকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়া ও মিডিয়ার সামনে শিক্ষার্থীদের নিয়ে নির্লজ্জ মিথ্যাচারের অভিযোগ এনে তাদের পদত্যাগের দাবিতে ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেয় শিক্ষক সমিতি। একই সঙ্গে লাগাতার কর্মবিরতির ঘোষণাও দেন শিক্ষকরা। শিক্ষকদের একটি প্রতিনিধি দল ভিসির কাছে এ দাবি জানালে তিনি পদত্যাগের ঘোষাণা দেন। কিছুক্ষণ পর পদত্যাগের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেন উপাচার্য। এছাড়া গত বছর ৯ জানুয়ারি ছাত্রলীগর হামলায় ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের নিহত হলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে প্রায় ৫ মাস উত্তাল ছিল ক্যাম্পাস।
শিক্ষার্থীদের অভিমত : বাংলা বিভাগের ৩৬তম ব্যাচের ছাত্র মো. আক্কাছ আলী খান বলেন, বর্তমানে জাতীয় রাজনীতি জনগণের কল্যাণের পরিবর্তে যেমন জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করছে ছাত্ররাজনীতির অবস্থাও ঠিক একই রকম। ছাত্রসমস্যার সমাধানের প্রতি দৃষ্টি দেয়ার পরিবর্তে ছাত্রদের সমস্যাই বেশি তৈরি করছে। ছাত্ররাজনীতি অবশ্যই দরকার কিন্তু বর্তমানের কলুষিত রাজনীতি নয়, এই ছাত্ররাজনীতি ছাত্রদেরকে অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দিচ্ছে। গণিত বিভাগের ৩৭তম ব্যাচের ছাত্র মাহমুদ হাসান বলেন, বর্তমান ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন তার অতীত ঐতিহ্য হারিয়ে দলীয় এজেণ্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তারা শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি উপেক্ষা করে নিজেদের আধিপত্যকেই গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রীতিলতা হলের ছাত্রী আনহা বুশরা সালাম সুহি বলেন, শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা ক্যাম্পাসে কখনও সংঘাত-সহিংসতা দেখতে চাই না। নির্দিষ্ট সময়ে লেখাপড়া শেষ করে দেশ ও জাতির জন্য অবদান রাখতে চাই। বেগম খালেদা জিয়া হলের রিতা বিশ্বাস বলেন, ছাত্ররাজনীতিতে মেধাবী, যোগ্য নেতৃত্ব না থাকায় ছাত্ররাজনীতি দিন দিন কুলষিত হচ্ছে। আর এ কারণে অভিভাবকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এ থেকে উত্তরণের পথ অবশ্যই আমাদের খুজে বের করতে হবে।
No comments:
Post a Comment