সেদিন ফেসবুকে দেখলাম একজন লিখেছেন "ছাত্রলীগ লিখে গুগলে সার্চ দেন, তারপরে দেখেন"! কৌতূহলী হয়ে দিলাম সার্চ, যা ভাবছিলাম ঠিক তাই, অর্থাৎ ছাত্রলীগের নানান সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের খবর। আসলেই এখন ব্যাপারটা অনেকটা তেমনই দাঁড়িয়েছে। ছাত্রলীগ এবং সন্ত্রাস-খুন-টেন্ডার বাজি সমার্থক শব্দ হয়ে গেছে প্রায়, যেমন হয়েছিল চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ছাত্রদল। প্রায় প্রতিটা দিন পত্রিকার পাতায় ছাত্রলীগের এমন কর্মকাণ্ড নিয়ে নিউজ থাকেই। সাধারণ পাবলিকের একটা বিতৃষ্ণা এসে গেছে ছাত্র রাজনীতির উপরে। অথচ আমাদের প্রায় সব গৌরবজনক অর্জনের সাথে ছাত্র সমাজ বা ছাত্র রাজনীতির ভূমিকা স্বর্ণালী অক্ষরে লেখা রয়েছে। কিছুদিন আগে ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে হত্যা করে বিশ্বজিতকে যা মিডিয়ার কল্যাণে আমরা টিভিতে দেখেছি, দেশে বিদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় এই ঘটনার পরে। এখন ছাত্রলীগ প্রসঙ্গে কিছু বলতে গেলেই প্রথমে চলে আসে বিশ্বজিত হত্যাকাণ্ডের কথা। কিন্তু আমি মনে করি সেদিনের ঐ হত্যাকাণ্ডের ভিডিও চিত্র ধারণ করা সম্ভব না হলে ঐ হত্যাকাণ্ড নিয়ে কারও কোন মাথা ব্যথা থাকতো না। দেশে আনাচে কানাচে এমন অনেক বিশ্বজিতদের প্রাণ দিতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কই সেসব নিয়ে তো তেমন কোন কথা হয় না।
যাই হোক, আমার লেখার উদ্দেশ্য ছাত্রলীগ বা বিশ্বজিত হত্যাকাণ্ড নয়, বর্তমানে ছাত্র রাজনীতির নেতিবাচক প্রচারণা প্রসঙ্গে। কখনও ছাত্রলীগ কখনও বা ছাত্রদলের কারণে সাধারণ পাবলিক যখন অতিষ্ঠ ছাত্র রাজনীতি প্রসঙ্গে, তখন ছাত্র রাজনীতির একজন প্রাক্তন কর্মী হিসেবে বর্তমান হাল হকিকত পর্যবেক্ষণ করে আমার কাছে মনে হয়, বর্তমানে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিগত তিনটি দশকের তুলনায় অনেক অনেক ভালো পরিবেশ রয়েছে। আগেই বলে রাখি এটা একান্তই আমার নিজের চিন্তা ভাবনা। তবে এই কথা বলার জন্য আমাকে পাগল ভাবলে সম্ভবত ভুল হবে। এই প্রসঙ্গে আশির দশকের জনপ্রিয় ব্যান্ডদল "চাইম" এর একটা গানের কথা মনে পড়লো, যেই গানে সেই সময়ের ছাত্র রাজনীতির একটা চিত্র ফুটে ওঠে। ঐ গানের কয়েকটা লাইন ছিল -
অনার্স কোর্স তিন বছর
লাগে মাত্র ছয় বছর
বাবার পকেটে লালবাতি জ্বলে
হায় মধুর পরিবেশ
হলের ডালে জীবন শেষ
পাস কোর্সে এ্যাটেন্ড করা ভালো
এ কেমন অভিশাপ বলো।
হ্যাঁ, এখনও সেশন জট রয়েছে, কিন্তু নির্দ্বিধায় বলা যায় আশি এবং নব্বইয়ের দশকের তুলনায় তা অনেকটা কম। অনির্ধারিত ছুটি এখনও দেয়া হয় তবে সেটাও ২০ বছর আগের মতো মহামারির আঁকার ধারণ করেনা। মনে করতে পারছি ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পরে ঐ বছর জুন থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে দেশের শতাধিক শীর্ষস্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ছাত্র সংঘর্ষের জের ধরে। সেই সময়ের সংঘর্ষগুলো হতো বর্তমানের চাইতে অনেক অনেক বেশী ভয়াবহ। দেশের প্রধান দুই বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক দিনেই যথাক্রমে ৪০০ এবং ১০০০ রাউন্ড গুলি বর্ষণের মতো ঘটনাও অতীতে ঘটেছে। এখন মিডিয়ার কল্যাণে অনেক স্থিরচিত্র বা ভিডিও আমরা দেখছি এবং শিউরে উঠছি। কোন ঘটনায় ছোড়া হাতে থাকা কোন যুবকের ছবি বৃত্ত এঁকে মার্ক করে দেয়া হচ্ছে পত্রিকার পাতায়। পাইপ গান বা পিস্তল বিভলবার হলে তো কথাই নেই। কিন্তু আজ থেকে ২৫ বছর আগে মিডিয়ার এতো সুযোগ সুবিধা থাকলে ছোড়া-রিভলবার-নাইন এমএম এর বদলে কাঁটা রাইফেল, কাঁটা বন্দুক, এলএমজি, শটগান, চাইনিজ রাইফেল বা জি থ্রি রাইফেলধারীদের ছবি হর হামেশাই দেখা যেতো। সেই সময়টা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হাত বাড়ালেই পাইপ গান, সিঙ্গেল শুটার, শাটার গান, এলজি'র দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া যেতো। অনেক কথা বলে ফেললাম। লেখার পরিধি বড় হয়ে গেলো। মূল প্রসঙ্গে যাই।
দেশের শুধুমাত্র একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের পেশী শক্তি নির্ভর ছাত্র রাজনীতির দিকে দৃষ্টি দিলেই বুঝা যাবে আমি কেন বলছি বর্তমান সময়ে শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ অতীতের যে কোন সময়ের থেকে অনেক ভালো। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে খ্যাত, বাংলাদেশের সকল প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ স্বাধীনতার পর থেকে ঢাবি ক্যাম্পাসে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের অন্তত ৬০ নেতাকর্মী খুন হয়েছেন। সরকার বিরোধী আন্দোলন, ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তার, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, চাঁদাবাজির টাকা ভাগবাটোয়ারা করা নিয়ে মুখোমুখি বন্দুক যুদ্ধে এবং কিছু ক্ষেত্রে পরিকল্পিতভাবে এসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। শুধু শিক্ষার্থীই নয় খুন হয়েছে একাধিক কর্মচারী ও বহিরাগতও।
সদ্য স্বাধীন দেশে অনেকের কাছেই আগ্নেয়াস্ত্র থাকা স্বত্বেও সত্তুরের দশকের এর ব্যবহার খুব একটা দেখা যায়নি ঢাবি ক্যাম্পাসে। তবে পচাত্তরের পট পরিবর্তন এবং সামরিক শাসক জেনারেল জিয়ার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই বৃদ্ধি পেতে অস্ত্রের অব্যবহার। বিশেষ করে আশির দশকে ছাত্রদলের মাধ্যমে সম্পূর্ণ পেশী শক্তি নির্ভর ছাত্র রাজনীতির একটা ধারার সৃষ্টি হয়। দেশব্যাপী প্রতিটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আধিপত্য বিস্তারে ব্যাপকহারে শুরু হয় অস্ত্রের ব্যবহার। শুধু প্রতিদ্বন্দ্বী অন্যান্য সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধেই নয় নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বেও অস্ত্রের ব্যবহার ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়।
সে সময় "সন্ত্রাস যদি শিল্প হয়, আমি সেই শিল্পের সার্থক শিল্পী" উক্তি করে সন্ত্রাস নির্ভর ছাত্র রাজনীতির মডেল বনে যাওয়া ঢাবির কুখ্যাত সন্ত্রাসী গোলাম ফারুক অভি, সানাউল হক নীরু ও নতুন বাংলা ছাত্র সমাজ থেকে ছাত্রদলে আসা ইলিয়াস আলীর নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অভি-নীরু গ্রুপ এবং ইলিয়াস গ্রুপ নামে পরস্পর বিরোধী দুটি গ্রুপের উত্থান ঘটে।
উভয় গ্রুপের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংঘর্ষ ঘটেছে বহুবার। নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার সন্ত্রাসীদের এনে হলে তোলে উভয় গ্রুপই। এই সময়েই ক্যাম্পাসে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়। ইলিয়াস গ্রুপ ও অভি-নীরু গ্রুপের বন্দুক যুদ্ধ, সংঘর্ষ, বোমাবাজি রীতিমতো নিয়মিত ব্যাপার হয়ে যায়। ঘটতে থাকে একের পর এক হত্যাকাণ্ড।
ক্যাম্পাসে মোট চারটি সংগঠনকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার জন্য অভিযুক্ত করা যায় নিঃসন্দেহে। ছাত্রদল, জাসদ ছাত্রলীগ, নতুন বাংলা ছাত্র সমাজ এবং আওয়ামী ছাত্রলীগ। অবশ্য আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে এরশাদ নতুন বাংলা ছাত্র সমাজকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে।
বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় এসময়। একেকটা হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একটা করে তদন্ত কমিটি গঠন করে দায়িত্ব শেষ করেছে, আজ পর্যন্ত সেসব তদন্ত কমিটির কোন প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। সেখানে বিচার হওয়া তো অনেক দূরের কথা। অবশ্য একটা হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছিল এবং ১৯৮৭ সালে এক ছাত্র সংঘর্ষের জের ধরে ঢাবি কর্তৃপক্ষ জাসদ ছাত্রলীগ এবং জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ১২ জন নেতা কর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করেছে।
১৯৭২ সালের ডাকসু নির্বাচন এবং ছাত্রলীগ বিভক্ত হওয়ার পূর্বে এবং পরে একাধিকবার ক্যাম্পাসে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলেও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ঢাবিতে প্রথম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ১৯৭৪ সালে। এবারে দেখা যাক ঢাবি ক্যাম্পাসে স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত ঘটা হত্যাকাণ্ডের কিছু বিবরণ -
সেভেন মার্ডার, ৪ এপ্রিল ১৯৭৪ : ১৯৭৪ সালের ৪ এপ্রিল প্রথম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এদিন সংঘটিত হয় এক নির্মম হত্যাকাণ্ড। যা ঢাবির ইতিহাসে কুখ্যাত সেভেন মার্ডার নামে খ্যাত। সেদিন অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে মুজিববাদী ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলমসহ প্রায় ১৫ জনের একটি সশস্ত্র গ্রুপ রাত আনুমানিক দেড়টার দিকে সূর্যসেন হলের ৬৪৫ ও ৬৪৮ নম্বর কক্ষ থেকে ৭ জন ছাত্রকে তুলে নিয়ে যায় মুহসীন হলে। পরে মুহসীন হলের টিভি রুমের সামনের করিডোরে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হয় তাদের। সেদিন যারা নিহত হয়েছেন তারা হলেন -