রাজশাহী : দলীয় কোন্দলের জের ধরে রাবিতে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে সংঘর্ষে সশস্ত্র মহড়া- সংগ্রাম
মশিউর রহমান ও বোখারী আজাদ, রাজশাহী অফিস : প্রশাসনের আশ্রয়-প্রশ্রয় এবং প্রতিপক্ষ কোন সংগঠন না থাকায় বেপরোয়া হয়ে উঠছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ। এক সময় প্রশাসনের যেই কর্তা ব্যক্তিরা গোপন পরামর্শ এবং শিবিরকে দুর্বল করে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের একক আধিপত্য স্থাপন করতে সর্বস্ব দিয়ে সহযোগিতা করেছিল তারাই এখন আর বেপরোয়া ছাত্রলীগকে সামাল দিতে পারছে না। গত ৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগ-শিবির সংঘর্ষের পর গত ছয় মাসে শুধুমাত্র ছাত্রলীগ নিজেদের মধ্যে কমপক্ষে ২৫ বার সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। এতে শতাধিক আহত হওয়া ছাড়াও ছাত্রলীগের সেক্রেটারিসহ গ্রেফতার হয়েছে ডজন খানেক। পাল্টাপাল্টি মামলাও হয়েছে একাধিকবার। ছাত্রলীগের মধ্যে দলীয় অন্তঃকোন্দল সামাল দিতে না পেরে অবশেষে রাবি ছাত্রলীগের কমিটিই বাতিল করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।
বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, রাবিতে ছাত্রলীগকে প্রতিষ্ঠা আর শিবিরকে প্রতিহত করতে সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন, রাবি প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন একযোগে কাজ করে। এ ক্ষেত্রে সফল হতে একের পর এক ফন্দি আটে। এ ধরনের একটি ফন্দির ফসল ৮ ফেব্রুয়ারির ফারুক হত্যাকান্ড কি না সে নিয়ে অনেকের সন্দেহ রয়েছে। ক্ষমতাশীন দলের ত্রিমুখী কৌশলে রাবি ক্যাম্পাস থেকে শিবির প্রতিহত করার ক্ষেত্রে কিছুটা সফল হলেও ছাত্রলীগকে প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয় মহলটি। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দলীয় গ্রুপিং, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, শিক্ষক ও ছাত্রী লাঞ্ছনার ঘটনায় সরকার দলীয় এই ছাত্র সংগঠনটি সাধারণের নিকট গ্রহণযোগ্যতা পেতে দারুণভাবে ব্যর্থ হয়। কমিটি গঠনের ছয় মাস যেতে না যেতেই ২৫ বারের মতো অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ছাত্রলীগ। প্রতিপক্ষ না পেয়ে ছাত্রলীগ নিজেরাই অস্ত্রের ঝনঝনানিতে মেতে ওঠে রাবি ক্যাম্পাসে। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ভর্তি বাণিজ্য, চাকরি বাণিজ্যের টাকা ভাগবাটোয়ারা, আধিপত্য বিস্তারের ঘটনায় প্রতিনিয়তই মারামারিতে লিপ্ত হয় নিজেরাই। সভাপতি গ্রুপ, সেক্রেটারি গ্রুপ, ক্যাম্পাস গ্রুপ, বহিরাগত গ্রুপ, স্থানীয় যুবলীগ আর ক্যাম্পাসের ছাত্রলীগের মধ্যে চলতে থাকে লাগাতার সংঘর্ষ। এর পর দেখা দেয় মেয়র-ভিসির দ্বনদ্ব। চাকরিতে নিজ নিজ বলয়ের লোক ঢোকানোর ঘটনায় মেয়র-ভিসি দ্বনদ্ব প্রকাশ্য রূপ লাভ করে। ফলে বেপরোয়া হয়ে ওঠা ছাত্রলীগকে সামাল দেবার মতো কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। বর্তমান প্রশাসন দায়িত্ব গ্রহণের পর দুই ছাত্র হত্যাকান্ডের ঘটনায় ক্যাম্পাস পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এই ঘটনার পর ছাত্রলীগের নিজেদের সংঘর্ষ ও মারামারিতে ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হয়।
নিজেদের মধ্যে বোমা বিস্ফোরণে সভাপতি আহত
নিজেদের মধ্যে বোমা বিস্ফোরণে সভাপতি আহত
৩০ মার্চ গভীর রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বোমা বিস্ফোরণে রাবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতিসহ পাঁচ নেতাকর্মী আহত হয়। বঙ্গবন্ধু হলের ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত ২৩২, ২৩৩ নং কক্ষে গভীর রাতে বোমা বানাতে গিয়ে এ ঘটনা ঘটে বলে জানা গেছে। এই ঘটনায় আহতরা হলেন ছাত্রলীগ সভাপতি আওয়াল কবির জয়, ব্যবস্থাপনা বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী সোহেল, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী রনি, জনি এবং মামুন। ৪ ও ৫ জুলাই রাবিতে ছাত্রলীগ ও বহিরাগত যুবলীগের মধ্যে দুই দিন ব্যাপী সংঘর্ষ চলে। এ সময় যুবলীগের হামলায় ছাত্রলীগের ৭ জন গুরুতর আহত হয়। এ সময় গোলাগুলীর ঘটনা ঘটে।
বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় ছাত্রলীগ সেক্রেটারি গ্রুপ সভাপতি গ্রুপকে দায়ী করে। এ ব্যাপারে রাবি শাখা ছাত্রলীগ সেক্রেটারি মাজেদুল ইসলাম অপু বলেন, সভাপতি নিজে বঙ্গবন্ধু হলের শিক্ষার্থী না। তিনি আমীর আলী হলের সংযুক্ত ছাত্র। অথচ প্রতি হলে সেক্রেটারি গ্রুপকে কোণঠাসা করার জন্য ছাত্রলীগ সভাপতি নিজে বোমা বানাতে সহায়তা করছে। এর অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধু হলে এ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে দাবি করে সুষ্ঠুৃ তদন্তের ভিত্তিতে এর সাথে জড়িতদের শাস্তি দাবি করেন। ৭ আগস্ট ও ১২ আগস্ট ঘটে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ সবচেয়ে বড় সংঘর্ষ। এই ঘটনায় ছাত্রলীগের রাবি সেক্রেটারি মাজেদুল ইসলাম অপু গ্রেফতার হয়। গত এপ্রিল মাসে জোহা হলের এক ছাত্রলীগ কর্মীকে ১০ টাকা চাঁদা না দেয়ায় সিগাটেরের জলন্ত আগুনের ছেঁকা দেয়া হয়। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে শিবির বলে আখ্যা দিয়ে মারধর করা ও পুলিশে ধরিয়ে দেয়ারও ভয় দেখানো হয় শিক্ষার্থীদের। গত ১৪ আগষ্ট আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দু'পক্ষের মধ্যকার সংঘর্ষ ও গোলাগুলীর ঘটনায় একজন গুলীবিদ্ধসহ উভয় পক্ষের অন্ততপক্ষে ১৫ নেতাকর্মী আহত হয়। এদের মধ্যে সভাপতি গ্রুপের মেহেদী (সংস্কৃতি ২য় বর্ষ), সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের সাকিব (রসায়ন ১ম বর্ষ), ফারদিন (&ইসলামের ইতিহাস ৪র্থ বর্ষ) ও তানিমের অবস্থা আশংকাজনক। মেহেদী ও সাকিব গুলীবিদ্ধ ও ফারদিন ও তানিম চাইনিজ কুড়ালের কোপে মারাত্মক আহত হয়।
সংঘর্ষ চলাকালীন সময়ে উভয় গ্রুপের মধ্যে কমপক্ষে বিশ রাউন্ড গুলীবিনিময় হয়। গ্রেফতার করে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয় সাধারণ সম্পাকসহ তিন নেতাকর্মীকে। এ ঘটনায় উভয় গ্রুপের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি দুটি মামলা দায়ের করা হয়। সর্বশেষ গত ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে কাঙ্গালী ভোজের অনুষ্ঠানে খাবারের প্যাকেট বিতরণ নিয়ে লাগে ছাত্রলীগ দুই গ্রুপে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। এই ঘটনায় আহত হয় ৮ জন। ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যে লাগাতার সংঘর্ষ থামাতে না পেরে অবশেষে কমিটি বাতিল করে ছাত্রলীগ রাবি শাখার কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় কমিটি।
ছাত্রলীগের দু'পক্ষের মধ্যকার একের পর এক সংঘর্ষ ও গোলাগুলীর ঘটনায় ক্যাম্পাসের শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষার্থীরা ব্যাপক আতংকে ক্যাম্পাসে অবস্থান করছে বলে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছে। ছাত্রলীগের বিবদমান দুই গ্রুপের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও প্রকাশ্য দিবালোকে গোলাগুলীর ঘটনার পরেও ছাত্রলীগের পক্ষে সাফাই গেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর প্রফেসর চৌধুরী মো. জাকারিয়া বলেছেন, ৩০ হাজার ছাত্র-ছাত্রীর এই এতো বড় ক্যাম্পাসে এরকম দু'একটি ছোট খাটো ঘটনা ঘটতেই পারে। এটা বড় কিছুই নয়। তারপরেও চেষ্টা করছি পরিস্থিতি শান্ত রাখার জন্য। ভবিষ্যতে আর তেমন কিছুই ঘটবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
ইতিহাস বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র সুমন ও আরিফ বলেন, সামনে মাস্টার্স পরীক্ষা দেয়ার পর চাকরির বাজারের টিকে থাকার জন্য বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে ব্যাপক পড়াশোনা করা দরকার। কিন্তু ক্যাম্পাসের বর্তমান পরিস্থিতি এতটাই ভীতিকর যে পড়াশুনায় মনোযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। অবিলম্বে রাবি প্রশাসনকে ক্যাম্পাসে শিক্ষার সূষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টিরও দাবি জানান তারা।
No comments:
Post a Comment