অপরাধ জগতের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে দেশের অন্যতম শীর্ষ প্রতিষ্ঠান ঢাকা কলেজ। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, কলেজ নিয়ন্ত্রণ এবং ক্যাম্পাস সংলগ্ন এলাকায় চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র আবারো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দেশসেরা এই কলেজটি। আধিপত্যের লড়াইয়ে টিকে থাকতে প্রায়ই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছেন ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা। চলছে গুলিবিনিময়, ককটেল নিক্ষেপ আর ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। এতে ক্যাম্পাসের হলগুলো এখন অস্ত্রের কারখানায় পরিণত হয়েছে। পিস্তল, রাম দা, চাপাতি, চাইনিজ কুড়াল, রডসহ এমন কোনো দেশি-বিদেশি অস্ত্র নেই- যার অস্তিত্ব এ কলেজে নেই। হলের 'পলিটিক্যাল রুম' খ্যাত কক্ষ ছাড়াও প্রায় প্রতিটি রুমেই অস্ত্রের বিস্তার ঘটেছে। সর্বশেষ এ অস্ত্রের ব্যবহারেই বলি হয়েছেন ফারুক নামে এক সাধারণ শিক্ষার্থী। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের গুলিবিনিময়কালে নিহত হন প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ওই ছাত্র।
তবে কলেজ প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নীরব ভূমিকার কারণেই ফারুক নিহত হয়েছেন বলে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন। তাদের আশঙ্কা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ধারাবাহিক এই অস্ত্রের প্রতিযোগিতা চলতে থাকলে অচিরেই কলেজ ক্যাম্পাসে বড় ধরনের সহিংসতা হতে পারে। অসুস্থ রাজনীতির বলি হতে পারেন কলেজের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, গত বছরের ৩ অক্টোবর এফএইচ পল্লবকে সভাপতি ও সাকিব হাসান সুইমকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি গঠনের পর থেকেই ক্যাম্পাসে আধিপত্যের বেশ কয়েকটি গ্রুপ জড়িয়ে পড়ে। প্রতিটি গ্রুপই নিজেদের টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সব কাজ করতে প্রস্তুত। এতে তারা অস্ত্রের খেলায় মেতে উঠেছেন। কলেজে কার কত অস্ত্র আছে সেটিই বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রুপকে বড় করে সাজাতে গিয়ে প্রায় প্রতিদিনই কলেজ ক্যাম্পাসে চলে অস্ত্রের মহড়া। চলছে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। সম্প্রতি এমন কাজকর্ম আরো বেড়ে গেছে বলে ঢাকা কলেজ সূত্রে জানা গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আধিপত্যের লড়াইয়ে টিকে গিয়ে বর্তমানে কলেজটিতে দুটি গ্রুপই সক্রিয় অবস্থানে রয়েছে। কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি পল্লব কেন্দ্রীয় সভাপতি এইচএম বদিউজ্জামান সোহাগের আশীর্বাদপুষ্ট। কলেজ শাখার সভাপতি মনোনীত হওয়ার পর নিজস্ব গ্রুপ গোছাতে ব্যস্ত ছাত্রলীগের এই নেতা। কেন্দ্রীয় সভাপতি সোহাগ তাকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেন বলে ছাত্রলীগ ঢাকা কলেজ সূত্রে জানা গেছে।
ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাকিব আল হাসান সুইম ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ঢাকা কলেজ শাখার সাবেক যুগ্ম-আহ্বায়ক মাহমুদুল হাসান টিটোর আশীর্বাদে নেতা হয়েছেন। নেতা হওয়ার পর সুইম টিটো গ্রুপ থেকে বেরিয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলমকে অনুসরণ শুরু করেন। বর্তমানে তিনি সিদ্দিকী নাজমুল আলমের লোক বলে ক্যাম্পাসে পরিচিত।
অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যমতে, কলেজের বর্তমান কমিটি গঠনের পর থেকে কলেজ ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের গ্রুপের মধ্যে ৮-১০টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সবগুলো সংঘর্ষেই কমপক্ষে ৫-৬ রাউন্ড গুলি বিনিময় এবং ১৫-২০টি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া চাপাতি, রামদা, চাইনিজ কুড়াল, হকিস্টিক এবং লাঠিসোঁটা নিয়ে দুইগ্রুপের মহড়া নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। কিছুদিন আগে দুইগ্রুপের মারামারির সময় জীবন নামে একজন ছাত্রলীগ কর্মী চাপাতির কোপে গুরুতর আহত হন। বর্তমানে তিনি এখন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন। এছাড়া অপর একটি সংঘর্ষে কলেজ শাখা ছাত্রলীগের মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক জুলফিকারের পায়ে গুলি লাগে। সর্বশেষ কলেজের মেধাবী ছাত্র ফারুক দুইগ্রুপের গুলিবিনিময়ের মাঝে পড়ে নিহত হন।
চাঁদাবাজি : বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা নিউমার্কেটে অহরহ চাঁদাবাজি করেন। কিছুদিন আগে কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সুইমসহ আরো কয়েকজনকে নিউমার্কেট মালিক সমিতির কার্যালয়ে আটকে রাখা হয়। তারা লেগুনা স্ট্যান্ড থেকে ও নিউমার্কেটের ফুটপথের দোকানগুলো থেকে প্রতিমাসে নির্দিষ্ট হারে চাঁদা আদায় করেন। চন্দ্রিমা সুপার মার্কেটে চাঁদা আদায় করতে গেলে সভাপতি পল্লবের অনুসারী ৬-৭ জন কর্মীকে বেদম প্রহার করা হয়। নিউমার্কেট এলাকায় অবস্থিত বিভিন্ন কোচিং সেন্টার থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করেন তারা। কিছুদিন আগে পল্লবের অনুসারীরা শোকস নামক মোজার শোরুমে চাঁদা দাবি করে। চাঁদা না দেয়ায় ওই শোরুম তারা ভাংচুর করেন। গ্লোব মার্কেট, প্রিয়াঙ্গন মার্কেট থেকেও চাঁদা আদায় করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এছাড়াও ঢাকা কলেজের পাশে ওরাকল, কনফিডেন্স, ইউসিসি, ইউনিএইড, উদ্ভাস এবং সাইফুরসসহ বিভিন্ন কোচিং সেন্টারগুলো থেকে চাঁদা নেয়ার অভিযোগ রয়েছে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।
জানা গেছে, কলেজের অস্ত্রের গুদাম হিসেবে পরিচিত নর্থ হলের ২০২, ১০৯, ১০৭, ২০৮, এবং ২০৫ নাম্বার কক্ষ থেকে সরবরাহকৃত অস্ত্র দিয়ে নেতাকর্মীরা এসব চাঁদাবাজি করেন বলে জানা গেছে।
ভর্তি বাণিজ্য : চলতি বছর এইচএসসি ভর্তিও সময় দুইগ্রপের মধ্যে গোলাগুলি হয়। এ সময় উভয়পক্ষের মধ্যে ২০-২৫ রাউন্ড গুলি বিনিময় হয়। কোচিং সেন্টারে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করানোর বিনিময়ে নির্দিষ্ট হারে কমিশন আদায় করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, বিসিএসসহ পিএসসির অধীনে নিয়োগ পরীক্ষা, বিভিন্ন ব্যাংকে নিয়োগ পরীক্ষা এবং বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে কলেজের একাধিক ছাত্রলীগের নেতার যোগসাজশ রয়েছে বলে জানা যায়। এসব পরীক্ষায় জালিয়াতি করে প্রতিবছর তারা হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা।
মাদক ব্যবসা : সূত্র জানায়, ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাসে বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য মুড়ি-মুড়কির মতো বিক্রি করা হচ্ছে। হাত বাড়ালেই ইয়াবা থেকে শুরু করে সব ধরনের মাদকদ্রব্য সেখানে মেলে। এসব মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুইগ্রুপের সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ ইয়াবা ক্রয় সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে ছাত্রলীগের দুইগ্রপের সংঘর্ষে নিহত হলেন কলেজের নিরীহ মেধাবী ছাত্র ফারুক।
এ বিষয়ে কলেজের অধ্যক্ষ ড. আয়শা বেগম যায় যায় দিনকে জানান, দীর্ঘদিন ধরেই ক্যাম্পাস শান্ত ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই এ ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা অপ্রত্যাশিত। তিনি বলেন, ঢাকা কলেজে আগের চেয়ে অনেক গতিশীলতা এসেছে। ভবিষ্যতে এর মান ধরে রাখা হবে। কলেজে অস্ত্রের আমদানি ও চাঁদাবাজির বিষয়টি ইঙ্গিত করলে এ বিষয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।সুত্রঃ যায়যায় দিন
No comments:
Post a Comment