সন্ত্রাসী উচ্চারণ যাদের জিহ্বার নিত্যকর্ম তারা সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল করার জন্য যতই পবিত্র বাক্য বিস্তার করুক, তার দ্বারা যে কিছুই হওয়া সম্ভব নয়, এটা বাংলাদেশের এক বাস্তবতা। গত এক বছরে আওয়ামী লীগের শাসন আমলে সন্ত্রাস যেভাবে প্রায় অনিয়ন্ত্রিতভাবে বিস্তার লাভ করছে তার দিকে তাকিয়ে এর সত্যতার প্রমাণ নতুন করে পাওয়া যায়।
ডিসেম্বর ২০০৮-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়লাভের সঙ্গে সঙ্গে, মুহূর্ত মাত্র দেরি না করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সন্ত্রাস পুরোদমে শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ছাত্র সন্ত্রাস এমন পর্যায়ে দাঁড়ায় যাতে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হয়। তার এভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করার আগে পর্যন্ত অবশ্য আমাদের জানা ছিল না, আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে তিনি ছাত্রলীগেরও সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে নিজেকে পরিচিত করে রাখার জন্য তাদের ছাত্র সংগঠনটির গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করেছিলেন। কোন রাজনৈতিক দলের সভাপতি যে নিজেদের ছাত্র সংগঠনেরও সর্বোচ্চ নেতার পদ অধিকার করে থাকতে পারেন সেটা এর আগে কোথাও দেখা যায়নি। এ ধরনের কর্ম বা অপকর্মের পরিণতি কি হয় সেটা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী কর্তৃক ছাত্রলীগের উচ্চতম নেতৃত্বের পদ দখল করে রাখা থেকেই দেখা গেল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যত্র ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও তার প্রয়োজনে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করলেও এটা এক মহাসত্য যে, আওয়ামী লীগের গুণাবলী ছাত্রলীগের মধ্যে সংক্রামিত হওয়ার কারণেই তাদের দ্বারা উপরোক্ত সবকিছু ২০০৮-এর ডিসেম্বর থেকেই শুরু হয়েছে এবং এর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের অনেক কথাবার্তা ও তথাকথিত পদক্ষেপ সত্ত্বেও পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন হয়নি। নির্বাচনে বিজয় লাভের পর আওয়ামী লীগের চিহ্নিত ও শীর্ষ সন্ত্রাসীরা যেভাবে দেশে ফেরত এসে আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডের কাণ্ডারি হিসেবে আবার পূর্ব ভূমিকা পালনের জন্য তৈরি হচ্ছে ও তাদের তৈরি করা হচ্ছে তাতে ছাত্ররা যে তাদের বিরুদ্ধে মূল দলীয় নেতৃত্বের সমালোচনা ও হুমকিকে কোন গুরুত্ব দেবে না এবং তাকে এক ধরনের ভাঁওতাবাজি ও ভণ্ডামি মনে করেই চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, লুটতরাজ ও সন্ত্রাস চালিয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক।
এই স্বাভাবিক ব্যাপারটি দেখা গেল ২৯ জানুয়ারি ঢাকার শেরেবাংলা নগরে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায়। ওইদিন সন্ধ্যার দিকে ছাত্রলীগের কিছু কর্মী মেলায় আসা অল্প বয়স্ক মেয়েদের হয়রানি করতে থাকা এবং পয়সা না দিয়ে দোকান থেকে জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেয়া, অর্থাৎ লুটপাট করতে শুরু করার সময় পুলিশ তাদের মাত্র কয়েকজনকে গ্রেফতার করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের একশ� জনের মতো ছাত্রলীগ কর্মী সেখানে এলোপাতাড়িভাবে একশ�র মতো গাড়ি ভাংচুর এবং ব্যাপকভাবে বিশৃংখলা সৃষ্টি করে। এর ফলে অনেকে আহত হয়। পুলিশ সূত্র থেকে জানানো হয়, ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতা ও সক্রিয় কর্মীদের নেতৃত্বেই অন্যর এই আক্রমণে নেতৃত্বে দেয়। (ডেইলি স্টার, ৩০ জানুয়ারি, ২০১০)
বাণিজ্য মেলার এ ঘটনা এখন কোন ব্যতিক্রমী ব্যাপার নয়। এটাই এখন প্রতিদিন ঢাকা ও দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এবং সাধারণভাবে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঘটছে। এদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে এখন জনজীবন সর্বক্ষেত্রেই বিপন্ন ও বিপর্যস্ত হচ্ছে। এদেশে আওয়ামী লীগ সাধারণ বুদ্ধিজীবী এবং আওয়ামী মার্কা লোকরা �জঙ্গি জঙ্গি� করে এমন আওয়াজ এখনও দিয়ে যাচ্ছে যাতে মনে হয় ধর্মীয় সন্ত্রাসীরাই এদেশে মূল সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালনা করছে। বিএনপি আমলে তাদের উস্কানি ও পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার ফলে তাদের যথেষ্ট উপদ্রব ছিল। কিন্তু এখন এ ধরনের জঙ্গিদের তৎপরতার প্রান্তিকীকরণ হয়েছে, তার অস্তিত্ব বিশেষ নেই বলেই চলে। এখন যারা দেশে ধর্মীয় জঙ্গিদের থেকে ব্যাপকতর এবং আরও মারা�কভাবে জনজীবনে সন্ত্রাস ও লুটতরাজের রাজত্ব কায়েম করেছে তাদের সঙ্গে ধর্মীয় কোন সংগঠনের যোগাযোগ নেই। তারা �ধর্মনিরপেক্ষ�। কাজেই আওয়ামী লীগের আমলে এখন �ধর্মনিরপেক্ষ� সন্ত্রাসীরাই ধর্মীয় জঙ্গিদের হটিয়ে দিয়ে নিজেদের রাজত্ব কায়েম করেছে।
�ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের� একাংশের ধারণা, দেশে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের শাসন প্রতিষ্ঠা হলে এবং ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলদের রাজনৈতিকভাবে হটিয়ে দিলেই দেশে প্রগতিশীলতার চাবিকাঠি খুলে যাবে, শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে এবং উন্নতির পথও উন্মুক্ত হবে। এটা যে এক মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর ধারণা আওয়ামী লীগই সেটা নিজেদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রকাশ করছে। ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলকেই যে প্রতিক্রিয়াশীলতার একমাত্র রূপ নয়, উপরন্তু ধর্মীয় কাঠামোর বাইরে থেকে আজকের দুনিয়ায় পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত শক্তিগুলোই যে প্রতিক্রিয়াশীলতার মূল ধারক-বাহক, এটাই বিশ্বের দেশে দেশে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ �ধর্মনিরপেক্ষতার� ঝাণ্ডা তুলে যেভাবে এক আগ্রাসী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে তার প্রমাণ মানুষ অনেকভাবেই পাচ্ছে। বাণিজ্য মেলায় ছাত্রলীগের সন্ত্রাস এই প্রতিক্রিয়াশীলতারই এক বিশেষ রূপ।
ছাত্রলীগ, যুবলীগ ইত্যাদি সংগঠন আজ দেশজুড়ে যে ছাত্র সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে একে কোন বিচ্ছিন্ন ব্যাপার মনে করার কারণ নেই। এর সাথে ছাত্রলীগের মূল দল আওয়ামী লীগের নাড়ির সম্পর্ক। ১৯৭২ সাল থেকে আওয়ামী লীগ এদেশের জনগণের ওপর যে সন্ত্রাস চালিয়ে এসেছে, যেভাবে লুটতরাজের মাধ্যমে অর্থসম্পদ অর্জনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে সেই প্রক্রিয়াই এখনও পর্যন্ত জারি আছে।
এর থেকেই বোঝা যায়, এদেশে ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে, বিশেষত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম প্রয়োজন হলেও সেই সংগ্রাম কোন মৌলিক সংগ্রাম নয়। মৌলিক সংগ্রাম হল শোষকদের যে শ্রেণীগত শাসন দেশে জারি আছে তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম। এ সংগ্রাম গণতান্ত্রিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে পারলে, তার অগ্রগতি ও সাফল্য নিশ্চিত করতে পারলে তার পার্শ্ব ফল হিসেবে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতা এমনিতেই উচ্ছেদ হবে। কারণ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলতা মূলত ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিক্রিয়ার সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। শুধু তাই নয়, এ প্রতিক্রিয়াশীলতা ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিক্রিয়াশীলতা থেকেই উদ্ভূত। এক কথায় বলা চলে, সাম্প্রদায়িকতাসহ সব ধরনের ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলতার কোন স্বাধীন ভিত্তি ও সত্তা নেই।
আওয়ামী লীগ নিজেও পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজেদের স্বার্থে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের সঙ্গে আপস করে ও মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এর অন্য অনেক দৃষ্টান্তের মধ্যে ১৯৯৬ সালে নির্বাচনের পর জামায়াতে ইসলামের সঙ্গে এবং ২০০৭ সালের ঘোষিত নির্বাচনের আগে ২০০৬ সালের শেষদিকে খেলাফত মজলিসের সঙ্গে সমঝোতা ও চুক্তির মাধ্যমে তারা নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষতার ভণ্ডামির প্রমাণ দেয়। শুধু আওয়ামী লীগই নয়, সাধারণভাবে প্রতিক্রিয়াশীলরা নিজেদের শোষণ-শাসনের প্রয়োজনে সব সময়ই ধর্মের আশ্রয় নিয়ে থাকে। কাজেই সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্ত হলেই যে জনগণ শোষণ ও প্রতিক্রিয়াশীল শাসনমুক্ত হবে, এ চিন্তা সম্পূর্ণ অবাস্তব ও বিভ্রান্তিকর। এ কারণে শারীরিকভাবে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনা না করে অথবা তাকে গৌণ জ্ঞান করে যারা সাম্প্রদায়িকতার উচ্ছেদকেই প্রগতিশীলতার মূল লক্ষ্য নির্ধারণ করেন তারা দেশে সাম্প্রদায়িকতার অবসান ঘটানোর পরিবর্তে সাম্প্রদায়িকতা টিকিয়ে রাখার জন্যই পরোক্ষভাবে এবং নিজেদের অজ্ঞাতসারে কাজ করেন।
ধর্মীয় জঙ্গিদের মোকাবেলা করার জন্য আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সঙ্গে একত্রে কাজ করার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে তাদের নিজেদের শাসন আমলে জঙ্গিবাদ অর্থাৎ সন্ত্রাস দমন করার ক্ষেত্রে তাদের বিশেষ কোন উদ্যোগ নেই। উপরন্তু তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত ছাত্র, যুবক এবং হাজার হাজার দক্ষ সন্ত্রাসী এখন দেশের অর্থনীতি ও জনগণের জীবন বিপর্যস্ত করছে।
এ বিষয়টিকে তার যথার্থ পরিপ্রেক্ষিতে দেখে, জনগণকে এর বিরুদ্ধ প্রতিরোধ সংগঠিত করতে হবে। মুখে জঙ্গিবাদের বিরোধিতা করে কার্যত দেশে সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষকতা করে নিজেদের শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকার যত চেষ্টা করছে তার বিরুদ্ধে সচেতন প্রতিরোধ ছাড়া যেমন এদের রাজনৈতিকভাবে উচ্ছেদ করা যাবে না, তেমনি পরবর্তী অন্য সন্ত্রাসীদের ক্ষমতায় ফেরত আসা প্রতিরোধ করাও সম্ভব হবে না।
সূত্রঃ যুগান্তর ৩১-০১-২০১০
No comments:
Post a Comment